২০২৪ সালের ৫ আগস্ট - বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অন্যরকম দিন। দীর্ঘদিনের শাসক শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলেন, পালালেন ভারতে যাদের তিনি গত পনরো বছরের শাসনামলে ঝুলি ভর্তি করে শুধু দিয়েই গেছেন। তারই ভাষায় ভারত সেটা "কখনো ভুলবেনা" । হ্যাঁ, সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই বোধ করি ভারত তার কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ব্যত্যয় ঘটিয়ে হলেও হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে, প্রশ্রয়ও দিচ্ছে অব্যাহতভাবে।
হাসিনার পতন নিয়ে এসেছিল জনমনে মুক্তির আনন্দ, সম্ভাবনার ঝলক। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সেই আশার আকাশে জমে উঠল গাঢ় সন্দেহের মেঘ।
৮ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করল একটি তথাকথিত “নিরপেক্ষ” অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু তাদের কার্যক্রম শুরু হতেই স্পষ্ট হতে থাকল—এটি কোনও ভিন্ন ভবিষ্যতের সূচনা নয়, বরং অতীতেরই এক প্রলম্বিত, পুনর্গঠিত, ও কৌশলী রূপ।
শাসকের প্রস্থান, কিন্তু শাসনের ধারাবাহিকতা
নতুন সরকারের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান করে নিলেন পূর্বতন সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা। যাঁদের কেউ কেউ শেখ হাসিনার আমলে ছিলেন বিভিন্নভাবে সুবিধাভোগী, কিংবা সরাসরি প্রশাসনিক চৌকাঠের অভ্যন্তরের খেলোয়াড়।
এ এক অদ্ভুত ক্ষমতার উত্তরাধিকার - যেখানে মুখ বদলেছে, কিন্তু মানসিকতা ও কাঠামো ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে। বিরুদ্ধ মত, প্রতিশ্রুত বিচার বা প্রশাসনিক সংস্কার - সবই কেবল প্রতীকী ভাষণে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।
'পরিবর্তনের' নামে প্রশাসনিক অচলাবস্থা
যে সরকার জনদাবির ফলস্বরূপ এসেছে বলে দাবি করে, তারা বিচারব্যবস্থায় সংস্কার বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কোনও স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি।
গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, দলীয় দখলদারিত্বের সহযোগী ব্যক্তিদের কেউই কাঠগড়ায় দাঁড়ায়নি। বরং, অনেকেই ফিরে পেয়েছে পুরোনো পদমর্যাদা, কেউ কেউ পেয়েছে আরও উচ্চতর ক্ষমতা।
রাষ্ট্র যেন এক সাংগঠনিক শীতনিদ্রায়, যেখানে পরিবর্তন কেবল একটি ভিন্ন আলংকারিক ভাষার নাম।
ডিজিটাল পরিসরে অস্থিরতার বিপজ্জনক উত্থান
এই শূন্যতা ও বিতৃষ্ণার সময়ে এক নতুন শক্তির উত্থান ঘটেছে - ইউটিউবার ও তথাকথিত স্বাধীন কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একটি নেটওয়ার্ক।
তাদের একটি অংশ রাজনৈতিক উত্তেজনা উস্কে দিচ্ছে, বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে এবং কখনো-কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে সংঘাতমূলক বর্ণনা নির্মাণ করছে। ফলাফল - জনমনে বিভ্রান্তি, রাস্তায় অস্থিরতা, এবং ভয়াবহ সামাজিক মেরুকরণ।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই ইউটিউবারদের অনেকেই আবার পুরনো ক্ষমতাসীনদের দ্বারা ম্যানেজড । ফলে তারা একদিকে “শাসকের সমালোচক”, অন্যদিকে “শাসকের রক্ষাকবচ” -এই দ্বৈত ভূমিকার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম চলমান এবং সরকার ও সমাজে তাদের প্রভাব ক্রমশঃ বেড়েই চলছে।
অপপ্রচার, ব্ল্যাকমেইল এবং .....
যেসব মানুষ বা সংগঠন এই ডিজিটাল দাপটের সঙ্গে আপোষ করে না, তারা দ্রুতই হয়ে ওঠে অপপ্রচারের লক্ষ্যবস্তু। চালানো হয় বিভ্রান্তিকর ভিডিও, ফেক ন্যারেটিভ, এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ।
এ তো সত্যি যে, গণমাধ্যমের বিকেন্দ্রীকরণ যেমন শক্তি সৃষ্টি করতে পারে, তেমনই ক্ষমতাকে সহায় করার একটি অত্যাধুনিক হাতিয়ারেও পরিণত হতে পারে।
নাগরিক সমাজ, একাডেমিয়া ও গণমাধ্যম: কোথায় সেই বিবেক?
অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা এবং ক্ষমতার পুনরুৎপাদনের বিপরীতে নাগরিক সমাজের প্রত্যাশিত প্রতিবাদ বা আলোচনাও আজ অনুপস্থিত।
একাডেমিক বুদ্ধিজীবী মহল ও তথাকথিত মধ্যপন্থী গণমাধ্যম এক ধরণের আত্মিক শূন্যতা ও নিরাপদ নীরবতায় শরণ নিয়েছে। যা প্রশ্ন তো তোলে বৈকি-গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব কি কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর? নাকি, এর ব্যর্থতা আমরা সবাই ভাগাভাগি করে নিচ্ছি?
২০২৪-এর আগস্টের ফলাফল হিসেবে আমরা যা পেলাম, তা শাসনের অবসান নয় - শুধু একটি শাসক-মুখের প্রস্থানের নাম।
হাসিনার পতন নতুন কিছু সৃষ্টি করেনি, বরং পুরোনো ব্যবস্থাকেই সুযোগ দিয়েছে আরও সূক্ষ্মভাবে শিকড় বিস্তারের। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং ডিজিটাল জনমাধ্যম উভয়ই মিলে এই পুনরুৎপাদনকে একটি সহনীয় স্বরূপ দিয়েছে।
সুতরাং প্রশ্নটা এখন স্পষ্ট: আদৌ কি এই দেশ একটি রূপান্তর প্রত্যক্ষ করেছে? নাকি ক্ষমতার কেবল দিক বদল ঘটেছে - কৌশলে?