নেতাকর্মিদের সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে মির্জা ফখরুল ইসলাম ও ডা. শফিকুর রহমান
রক্তাক্ত জুলাই যেন শেষ হচ্ছে না আমাদের। গত বছরের স্বৈরাচারী শাসকের গুলিতে নিহত শিশুদের চেহারা আমরা ভুলতে পারি না। সেই জুলাইয়ের স্মরণ চলাকালে আরেক জুলাইয়ে এসে আবারও আমাদের শিশুরা লাশ হলো। আগের জুলাইয়ে ঘাতকের গুলিতে আর এবার বিমানবাহিনীর এক প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায়।
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানটি আছড়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে যেভাবে আগুনে পুড়ে যাওয়া বাচ্চাদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল, তা দেখে যেকোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের চিন্তা অবশ হয়ে যাওয়ারই কথা। আর যাঁরা সন্তানের মা-বাবা, তাঁদের মানসিক বিপর্যস্ততার কথা বললামই না।
এরপর তো একের পর এক পুড়ে যাওয়া শিশুর ছবি-ভিডিও, শিশুর খোঁজ পেতে মা-বাবাদের আহাজারি, হাসপাতালে আহত শিশু নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন—যেন পৃথিবীর কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, এমন বেদনাদায়ক দৃশ্য একের পর এক হাজির হতে থাকে আমাদের সামনে।
কেউ বাচ্চার খোঁজ পেতে শিশুর ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন, আবার কেউ হাসপাতাল থেকে শিশুর অভিভাবকের খোঁজ পেতে তার স্কুল আইডির ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন। আর রক্তের জন্য গোটা ঢাকাবাসী যেন পারলে ছুটে যায় উত্তরার সব হাসপাতাল থেকে শুরু করে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে।
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার অল্প মুহূর্তের মধ্যে মানুষের ঢল নামে যেন। উদ্ধার কার্যক্রমে যুক্ত মানুষের চেয়েও উৎসুক মানুষের ভিড় বেশি। কে কত কাছ থেকে ছবি ও ভিডিও তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিতে পারবে, সেই প্রতিযোগিতাও যেন দেখা যায়। দেখা গেছে, অন্য যেকোনো ঘটনার চেয়ে আজকে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে হেলিকপ্টারে করে সেনাবাহিনীর টিমসহ অন্যান্য উদ্ধার সহায়তা দল ঘটনাস্থলে হাজির হতে সক্ষম হয়েছে। দ্রুত বিধ্বস্ত বিমান ও ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের আগুন নেভানোও সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু হতাহতদের উদ্ধার থেকে শুরু করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে চরম বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়েছে উদ্ধারকারীদের। ঘটনাস্থল থেকেই বিষয়টি বারবার বলা হচ্ছিল। অতিরিক্ত মানুষের কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সময় যত যায়, ততই যেন মানুষের ঢল বেড়েছে।
স্কুলের বাচ্চার খোঁজ নিতে যেকোনো মা-বাবা পাগলের মতো ছুটে যাবে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের ঢল কেন? সাধারণ মানুষের সাইকি বা মনস্তত্ত্ব আমরা বুঝি। কিন্তু যেসব রাজনীতিবিদ এ মুহূর্তে দলবলে হাসপাতালে ছুটে গেলেন, সেটিকে আমরা কী বলব?
গত শনিবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বক্তব্য দিতে দিতে মঞ্চেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেদিনই রাতে তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রাজনৈতিক শিষ্টাচার বা কালচারের জায়গায় বিষয়টি বেশ প্রশংসিতও হয় রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজের মধ্যে। কিন্তু আজকে এই দুই অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতার ওপরেই মানুষ ক্ষুব্ধ হলো। কারণ, তাঁরা দুজনই নেতা-কর্মী নিয়ে সদলবলে হাসপাতালে ছুটে গেছেন।
হ্যাঁ, আমাদের অনেক সক্ষমতার অনেক ঘাটতি আছে, অনেক কিছু ব্যর্থতা আছে। কিন্তু একদম জরুরি মুহূর্তে রাজনৈতিক নেতাদের সদলবলে হাসপাতালে ছুটে যাওয়ার তো কোনো মানেই হয় না! আরও হাস্যকর বিষয় হলো, তাঁদের কেউ কেউ হাসপাতালের সামনে গিয়ে মানুষের দিকে হাত নাড়ছেন। এটি কি কোনো নির্বাচনী প্রচারণা?
ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট পর্যন্ত মানুষের ভিড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে এখানের ভিড় প্রধানত রক্ত দিতে ছুটে আসা মানুষের। এরপরও মানুষের ভিড়ের কারণে হাসপাতালে আসা–যাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্সের গতি কমে গেছে। এর মধ্যে আমরা দেখলাম রাজনৈতিক নেতারা দলবল নিয়ে হাসপাতালে ঢুকছেন। সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও হাসপাতালে ছুটে গিয়েছেন।
রাজনৈতিক নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে অন্যান্য নেতা–কর্মী–সমর্থক, নিরাপত্তাকর্মী, মিডিয়াকর্মী মিলিয়ে রীতিমতো একটা হট্টগোল পরিস্থিতি তৈরি হলো হাসপাতাল এলাকায়।
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে ভিড় সামলাতে কাজ করছেন অনেক স্বেচ্ছাসেবী। তাঁদের একজনের বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই তরুণী খুব আক্ষেপ নিয়ে বলছেন, ‘আমরা বাইরে স্ট্রাগল করছি, যাতে রোগীরা ভেতরে ঢুকতে পারে। ওনারা রাজনীতি করেন মানলাম, এখন কি এটা করার টাইম ছিল? ওনারা সবাই দল বেঁধে এক শ জন মিলে যাচ্ছেন, রোগী ঢুকতে পারতেছে না, ওনাদের রাজনীতিটা কি আগে? ওনারা যদি রাজনীতিবিদ না হতো, ওনারা কি এভাবে ঢুকতে পারতেন?’
বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক ভিডিও প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ও যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি। সেখানে তাঁদের ঘিরে এক প্রকার ধস্তাধস্তিও হয়েছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী তরুণ এই মুহুর্তে হাসপাতালের ভেতরে যেতে তাঁদের বাধা দিয়েছিলেন। সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হচ্ছেও দেখা যায়। আরেক ভিডিওতে দেখলাম এপ্রোন পরা এক নারী চিকিৎসক তাঁদের হাতজোড় করে অনুরোধ করছেন, হাসপাতালে এসে ভীড় না করতে। এটি কি কোনো সভ্য দেশের দৃশ্য হতে পারে?
এ মুহূর্তে রাজনৈতিক নেতাদের কারোরই হাসপাতালে যাওয়া কি খুব জরুরি ছিল? তাঁরা হাসপাতালে গেলে কি আহতরা দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন? জাতির এত বড় ট্র্যাজিডিতে সংবেদনশীল আচরণ করলেন কি তাঁরা?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড, সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণ, মগবাজার বিস্ফোরণের মতো একের পর এক বড় বড় দুর্ঘটনা সামাল দিয়েছেন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকেরা। এর আগে চুড়িহাট্টা, নিমতলী, রানা প্লাজার মতো আরও বড় বড় ট্র্যাজেডি সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা তো আছেই।
হ্যাঁ, আমাদের অনেক সক্ষমতার অনেক ঘাটতি আছে, অনেক কিছু ব্যর্থতা আছে। কিন্তু একদম জরুরি মুহূর্তে রাজনৈতিক নেতাদের সদলবলে হাসপাতালে ছুটে যাওয়ার তো কোনো মানেই হয় না! আরও হাস্যকর বিষয় হলো, তাঁদের কেউ কেউ হাসপাতালের সামনে গিয়ে মানুষের দিকে হাত নাড়ছেন। এটি কি কোনো নির্বাচনী প্রচারণা?
একটি ছবিতে দেখা গেল, জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ কেন্দ্রীয় নেতারা একজন রোগীর শয্যার চারপাশে ঘিরে ধরে তাঁর খবরাখবর নিচ্ছেন। জামায়াতের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজেই এ ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ এই সময়ে যেকোনো পোড়া রোগীর জন্য এটা হতে পারে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, যখন কেউ পুড়ে যান, তখন তাঁর ত্বকের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়। তখন সেই জায়গায় সহজে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে এবং সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, কোনো পোড়া রোগীর চারপাশে অনেক লোক জমে গেলে তাদের নিশ্বাস, জামাকাপড় বা স্পর্শের মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমণ আরও দ্রুত ছড়াতে পারে। তাই রোগীর পাশে অপ্রয়োজনীয় ভিড় কারা যাবে না। রাজনৈতিক নেতাদের এই ভিড় করা যে একেবারেই অপ্রয়োজনীয়, তা নিঃসন্দেহে যে কেউ স্বীকার করবেন।
সংবাদকর্মীদেরও কোনো পোড়া রোগীর কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই। অথচ সেটি আমরা করতে দেখলাম কোনো কোনো সংবাদকর্মীকে। সাক্ষাৎকারের নামে কোনো আহতের কাছ থেকে এই মুহুর্তে ‘অনুভূতি’ জানতে চাওয়াকে কোনোভাবেই সাংবাদিকতা বলা যায় না।
মাগুরার এক শিশু ধর্ষণ নিয়ে কয়েক মাস আগে দেশ প্রতিবাদে উত্তাল হলো। সেই শিশুকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় চিকিৎসার জন্য। তখনো আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা ওই শিশুকে দেখার জন্য তার কাছে গিয়ে ভিড় করেছেন। সেখানে গিয়ে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করেছেন। তখন বিষয়টি চরম সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।
আমাদের রাজনীতিবিদদের, রাজনৈতিক নেতাদের আসলে কবে হুঁশ হবে? বিপদের মুহূর্তে মানুষের কাছে ছুটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতারা জনগণের প্রতি তাঁদের ‘দরদ’ প্রকাশ করতে চান, সেটির জন্য ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানও যে তাঁরা অনেক সময় হারিয়ে ফেলেন, তা আজকের ঘটনায় আবারও প্রকাশ পেল।
লেখক: রাফসান গালিব, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী