আলোচিত কূটনীতিক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন- ফাইল ফটো
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আলোচিত কূটনীতিক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন অবশেষে কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। নিয়োগের প্রায় ৫ মাসের মাথায় আজ শুক্রবার তিনি টরন্টো পৌঁছেন। দুপুরে টরন্টোয় বাংলাদেশ কনস্যুলেট পরিদর্শন শেষে সড়কপথে সন্ধ্যায় অটোয়া যান। সেখানে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। দুদিন বিশ্রামের পর সোমবার থেকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস শুরু করবেন বলে জানা গেছে।
পেশাদার কূটনীতিক মো. জসীম উদ্দিন ছিলেন চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। গতবছরের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের একমাস পর অন্তর্বত্তী সরকার তাকে পররাষ্ট্র সচিব পদে নিয়োগ দেয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের বহুমূখী ষড়যন্ত্রে মাত্র ৮ মাসের মাথায় তিনি পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে সরে দাড়াতে বাধ্য হন। এই সিন্ডিকেটের প্রধানকে পররাষ্ট্র সচিবের চেয়ারে বসানোর ইচ্ছে ছিলো স্বয়ং সরকারের একটি শীর্ষ মহলের। অবশ্য পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কঠোর অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত সে চেষ্ঠা ব্যর্থ হয়।
বিভিন্ন মহলে আলোচনা ছিলো, সরকারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত, শীর্ষ কতিপয়ের ইচ্ছামাফিক নির্দেশনা না শুনা, নতুন বিশেষ সহকারীকে সেগুনবাগিচায় আসতে না দেয়া, কতিপয় ইউটিউবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক না রাখাসহ বিভিন্ন কারণে মাত্র ৮ মাসের মাথায় পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিনকে ছুটিতে যেতে হয়েছে। বিশেষ করে রাখাইনে মানবিক করিডোর নিয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের পর থেকে তার বিদায়ের গুঞ্জন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
পররাষ্ট্র সচিবকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে সেসময় এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, “অপসারণের কোনো বিষয় নাই। পররাষ্ট্র সচিব বিভিন্ন কারণে নিজে থেকে হয়ত সরে যেতে চান এবং আমরা তাকে সরে যেতে দিচ্ছি।
জসীম উদ্দিন ‘ছুটিতে যাচ্ছেন কিংবা চাকরি ছাড়ছেন কি না’, এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘উনি চাকরি ছেড়ে দেবেন কেন? উনিতো চাকরিতে আছেন। উনি যখন চাকরিতে আছেন, দায়িত্ব পরিবর্তন হবে।’
গত জুনের প্রথম সপ্তাহে সরকার জসীম উদ্দিনকে অটোয়া বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসাবে নিয়োগ দিয়ে কানাডা সরকারের কাছে এগ্রিমো পাঠায়। সুত্রমতে, তার এগ্রিমো যাতে অনুমোদন না হয়, সেই চেষ্ঠা ছিলো একটি মহলের। ফলে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দ্রুত এগ্রিমো অনুমোদনে অটোয়ার শীর্ষ কর্মকর্তাদের কোনো জোরালো ভুমিকা ছিলো না। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে তৎকালীন হাইকমিশনার নাহিদা সোবহানকে তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছিলো। কিন্তু কানাডার গ্লোবাল এফেয়ার্স সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সাথে কোন যোগাযোগ না থাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ি তিনি দ্রুততার সঙ্গে সম্মতি পত্র আদায়ে ব্যর্থ হন। ফলে নিয়োগের প্রায় ৫ মাসের মাথায় জসীম উদ্দিনকে অটোয়ায় আসতে হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রায় সকল কর্মকর্তার মধ্যে চাউর আছে যে, জসিম উদ্দিন সিনিয়র হলেও তার সঙ্গে অটোয়ায় সদ্য সাবেক হাইকমিশনার নাহিদা সোবহান সিন্ডিকেটের অনেক আগে থেকেই ব্যক্তিগত রেশারেশি ছিল। জসিম উদ্দিন বিএনপি ঘরানার হলেও নাহিদা সোবহান ছিলেন বিগত সরকারের সময়ে ব্যাপক সুবিধাভোগী। আওয়ামী লীগের আমলে একটি সিন্ডিকেট জসিম উদ্দিন কে নানাভাবে অপদস্ত করার চেষ্ঠা করতো।
পররাষ্ট্র সচিব ছাড়াও চীন, কাতার ও গ্রিসে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা জসীম উদ্দিন বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের ত্রয়োদশ ব্যাচের কর্মকর্তা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে তার অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার কথা রয়েছে।
এরআগে গণঅভ্যুত্থানের এক সপ্তাহের মধ্যে কানাডায় হাইকমিশনার হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত কূটনীতিক নাহিদা সোবহান। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে পুরস্কার হিসাবে কানাডায় নিয়োগ দিয়েছিলো। সরকার পতনের পরদিন তিনি নিয়োগ আদেশ বাতিলের আশঙ্কায় তৎকালীন সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সহাযোগিতায় জর্ডান থেকে ঢাকা হয়ে ৬ দিনের মধ্যে কানাডা পৌঁছে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে সে সময় তাকে নিয়ে নানামূখী বিতর্ক ও চাপ মোকাবেলা করতে হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে। কানাডায় টিকে থাকতেও তিনি নানা বিতর্কিত কাণ্ডের জন্ম দেন। এমনি প্রেক্ষাপটে সরকার তাকে মেয়াদপূর্তির আগেই কানাডা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। ছেলে-মেয়ে টরন্টোর দুটি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত থাকায় নাহিদা সোবহানের ব্যাপক আগ্রহ ছিলো কানাডা থাকার। চেষ্ঠাও করেছিলেন ব্যাপক, কিন্তু হয়নি।
অটোয়ায় রয়েছেন আরেক বিতর্কিত কর্মকর্তা ডেপুটি হাইকমিশনার রাসেল পারভেজ। ০৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরপরই সরকারবিহীন সময়ে রাতের আধারে আওয়ামী পররাষ্ট্র সচিবের আদেশে যে সকল পদায়ন হয়েছে তাদের অন্যতম এই রাসেল পারভেজ। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার ভূমিকা ছিলো ব্যাপক বিতর্কিত। বিতর্কিত সচিব মাসুদ বিন মোমন তাকে নিরাপদে দ্রুত কানাডায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।