চালু হওয়ার ৪ মাস পর উদ্বোধন করবেন ভোটার কার্যক্রম # মতবিনিময় করবেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে # ছেলের সঙ্গে কাটাবেন ব্যক্তিগত সময় # দায়সারা কার্যক্রম চলছে অটোয়া হাইকমিশনে
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন এখন কানাডায়। ১৪ দিনের সফরে তিনি আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টায় ইকে ২৪১ ফ্লাইটে টরন্টোর পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌছাঁন। কানাডায় বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার কাজী রাসেল পারভেজ ও টরন্টোয় বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেল মো. ফারুক হোসেন বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর দুপুর পর্যন্ত তিনি হোটেল প্যানপ্যাসিফিক টরন্টোয় অবস্থান করবেন। সিইসির সঙ্গে রয়েছেন লালমনিরহাট জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. লুৎফুল কবির সরকার।
নির্বাচন কমিশনের আদেশে বলা হয়েছে, সিইসি কানাডায় ভোটার কার্যক্রম উদ্বোধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ করবেন। অথচ চলতি বছরের ৭ মে টরন্টোয় এবং ৯ মে অটোয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে এনআইডি কার্যক্রম শুরু হয়। নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ ও আইডিইএ প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আজিজুর রহমান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি দল ৬ দিন টরন্টো ও অটোয়ায় অবস্থান করেন এবং তাদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে এনআইডি কার্যক্রম শুরু হয়। সুত্রমতে, ব্যাপক কারিগরি ত্রুটি (সার্ভার সমস্যা) এবং অনুমোদনের প্রক্রিয়াগত নানাবিদও সমস্যা কারণে এই কার্যক্রম চলছে খুবই টিমেতালে।
নির্বাচন কমিশন, ঢাকা সুত্র জানায়, টরন্টো ও অটোয়ায় গত প্রায় ৪ মাসে হওয়া মাত্র শতাধিক স্মার্ট কার্ড সঙ্গে নিয়ে কানাডা এসেছেন সিইসি। মূলত টরন্টো ও অটোয়ায় এগুলোই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিতরণ করবেন। এছাড়া ৪ মাস আগে চালু হওয়া ভোটার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। সুত্রমতে, টরন্টো ও অটোয়ায় বাংলাদেশ মিশনে ছোট পরিসরে কিছু রাজনৈতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ভোটার কার্যক্রম নিয়ে মতবিনিময় করবেন।
জানা যায়, ৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে সিইসি অটোয়া পৌঁছে হোটেলে লাঞ্চ ও বিশ্রাম করবেন। রাতে সিইসির সৌজন্যে ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের বাসায় ডিনারে অংশ নেবেন। পরদিন হাইকমিশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় হাইকমিশনে ভোটার নিবন্ধন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। এরই ফাঁকে ফাঁকে তিনি অটোয়ার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করবেন। একই ভাবে ৫ সেপ্টেম্বর সিইসি সফরসঙ্গী নিয়ে টরন্টো পৌঁছলেও ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর তার কোনো কর্মসূচি নেই। এই দুদিন মূলত নায়াগ্রা ফলসসহ অন্টারিওর দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করতে পারেন। ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে তিনি বাংলাদেশ কনস্যুলেট ভিজিট করবেন। সেখানে ভোটার নিবন্ধন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং টরন্টো প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
সিডিউল অনুযায়ি ১২ সেপ্টেম্বর সিইসি অটোয়া থেকে ভেঙ্কুভারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। সেখানে ৪ দিন তার ছেলের সঙ্গে কাটিয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন। ১৮ সেপ্টেম্বর তার ঢাকা পৌঁছার কথা রয়েছে। গত আগস্টে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সিইসি আফসোস করে বলেছিলেন, আমার ছেলে ভোটার হয়েও ভোট দিতে না পেরে কানাডা চলে গেছে। এবার কানাডা সফরের সুযোগে ছেলের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগও পাবেন সিইসি।
দীর্ঘ এই সফরে কানাডার নির্বাচন সম্পর্কিত কিংবা সরকারি কোনো কর্মকর্তা বা দপ্তরের সঙ্গে সিইসির সাক্ষাত কিংবা মতবিনিময়ের কোনো কর্মসূচি নেই বলে জানা গেছে। এবিষয়ে হাইকমিশনও কোনো উদ্যোগ নেয়নি। নির্বাচন কমিশন থেকেও হাইকমিশনকেও কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।
নির্বাচন কমিশন সুত্র জানায়, ইসির শীর্ষ কর্মকর্তারা এখন অপ্রয়োজনীয় এবং কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিদেশ সফর নিয়ে আগ্রহী। কানাডায় এনআইডির কার্যক্রম যে অবস্থায় চলমান, তাতে শতাধিক স্মাট কার্ড বিতরণে সিইসির কানাডা ভিজিট নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। একইভাবে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদও জাপানে যান সেখানকার প্রবাসীদের ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম তদারকির জন্য। অথচ প্রবাসীরা আগামী ফ্রেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে কি না, কিংবা কি প্রক্রিয়ায় প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা হবে, এসব বিষয়ে সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনে এখনও স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
বর্তমানে ১০টি দেশের ১৭টি দূতাবাসে নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। দেশগুলো হচ্ছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, ইতালি, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও কানাডা। ২০১৯ সালে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন বিদেশে এনআইডি দেওয়ার প্রকল্প শুরু করে। বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য অনলাইন নিবন্ধন প্রথম চালু হয় যুক্তরাজ্যে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। গত ১৫ জুলাই ইসি জানিয়েছিল, নয়টি দেশের ৪৮ হাজার ৮০ জন বাংলাদেশি প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) জন্য আবেদন করেছেন।
সুত্র আরো জানায়, কানাডায় হাইকমিশনার ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার অতি আস্থাভাজন হিসাবে পরিচতি নাহিদা সোবহান। শেখ হাসিনার পছন্দেই তাকে কানাডায় পোস্টিং দেয়া হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরপরই ফ্যাসিবাদি সরকারের অন্যতম সহযোগি সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সহযোগিতায় মাত্র ৬ দিনের মধ্যে নাহিদা সোবহান অটোয়ায় যোগদান করেন। সেসময় প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাকে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যায়িত করে ব্যাপক প্রতিবাদ করলে তিনি ঢাকা এবং কানাডায় রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক যোগাযোগ ও তদবির করে নিজকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন।
অপরদিকে জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পশ্চিম ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনুবিভাগের মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা কাজী রাসেল পারভেজকে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের পছন্দে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসাবে পদায়ন করা হয় কানাডায়। অথচ তীব্র আন্দোলনকালে এই রাসেল পারভেজ ইইউ ও এর আওতাভূক্ত দেশগুলোর কাছে হাসান মাহমুদ ও মাসুদ বিন মোমেনের পরিকল্পনা অনুযায়ি ফ্যাসিস্ট সরকারের জুলুম-নির্যাতন ও গণহত্যার বিষয়গুলো ধামাচাপা দিতে রাতদিন ব্যস্ত ছিলেন। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যাতে কোনো কথা না বলে সেজন্য তিনি জুলাইয়ের শেষ দিকে ইইউ’র এক্সটারনাল এ্যাফেয়ার্সের মহসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদের বৈঠক করিয়ে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার পালিয়ে যাওয়ার পর তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে কাজী রাসেল পারভেজসহ সেসময় হাসিনা সরকারের এসাইনমেন্ট পালনকারী কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দেশে পদায়ন এবং নিরাপদে দেশ ছেড়ে পদায়িত কর্মস্থলে যোগদান নিশ্চিত করেন।
একবছরের মাথায় সরকার নাহিদা সোবহানকে জেনেভায় বদলী করলে এই রাসেল পারভেজই এখন কানাডায় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার। সুত্র আরো জানায়, হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী এই দুই কূটনীতিক অন্তর্বত্তীকালীন সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল এবং নির্দেশনা বাস্তবায়নে খুবই উদাসিন। ফলে প্রায় চার মাস আগে সরকার কানাডায় এনআইডি কার্যক্রম শুরু করলেও হাইকমিশন তা ব্যাপকভাবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রচারের কোনো উদ্যোগ নিয়েনি। ফলে বিষয়টি এখনও অধিকাংশ বাংলাদেশির অজানা। সরকার নাহিদা সোবহানকে জাতিসংঘের মতো গুরুত্বপূর্ণ মিশনে স্থায়ী প্রতিনিধি করলেও কাজের মেয়ের ভিসা হয়নি, এই অজুহাতে দায়িত্ব ছাড়ার পরও ছুটি নিয়ে টরন্টোয় অবস্থান করছেন। অথচ আগামী ৮ সেপ্টেম্বর থেকে জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল এর ৬০ তম অধিবেশন শুরু হবে। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি কাউন্সিলে বাংলাদেশের পিআর প্রতিনিধিত্ব করবেন না। সবমিলে কানাডার মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল একটি মিশন চলছে খুবই টিমেতালে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিনকে কানাডায় হাইকমিশনার হিসাবে পদায়ন করা হলেও সদ্যসাবেক হাইকমিশনারের জোরালো উদ্যোগ না থাকায় এখন পর্যন্ত এগ্রিমো অনুমোদন হয়নি। ফলে জসিম উদ্দিন যোগদান করতে পারছেন না।