বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের বড় একটি অংশ নারী, তবে ঈদের আগেও বকেয়া বেতন-ভাতা নিয়ে তাদে
বাংলাদেশে ঈদ মানে শুধুই ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজন, যেখানে সমবণ্টন, সহানুভূতি এবং পারস্পরিক সম্মানের বিষয়গুলো অন্তর্নিহিত থাকার কথা।
কিন্তু এই সমাজে বৈষম্য এতটাই প্রোথিত যে, উৎসবের আলোর নীচেও থাকে গভীর অন্ধকার। বিশেষ করে, নারীর চোখ দিয়ে ঈদের অনুভূতি পড়তে গেলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এটি এক আনন্দের গল্পের পাশাপাশি সীমাবদ্ধতার লড়াই, আত্মত্যাগ এবং চাপা কান্নার অনুবাদ।
ঈদ কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি আমাদের সামাজিক বোধ, শ্রেণিবিভাজন, অর্থনৈতিক অসমতা এবং সম্পর্কের জটিল চিত্র তুলে ধরে। সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বুর্দিয়ু যে ‘সিম্বলিক ক্যাপিটাল' বা প্রতীকী পুঁজি-র কথা বলেছেন, ঈদ সেই প্রতীকী পুঁজির সামাজিক প্রদর্শনের এক বড় মঞ্চ। সমাজের উচ্চবিত্তের জন্য ঈদ হলো বৈভবের আরেকটি আনুষ্ঠানিকতা; মধ্যবিত্তের জন্য এটি আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই; আর নিম্নবিত্ত বা শ্রমজীবী নারীর কাছে ঈদ হলো নিজের ক্ষুদ্র সীমার মধ্যে সন্তানের মুখে একফোঁটা হাসি খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা। এই বৈপরীত্য আমাদের সমাজের শ্রেণিকাঠামোর নগ্ন প্রতিচ্ছবি।
শ্রেণিবৈষম্য ও নারীর নীরব সংগ্রাম: উৎসবের উজ্জ্বল আলোয় আড়াল হয়ে যাওয়া গল্প
বাংলাদেশের সমাজ-অর্থনৈতিক কাঠামোতে নারীর অবস্থান জটিল এবং বহুমাত্রিক। তিনি যেমন অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি- তৈরি পোশাক শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা, কৃষি ও বেসরকারি খাতে শ্রম দিয়ে পরিবার ও দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছেন; ঠিক তেমনই সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বয়ানে তাকে প্রায়ই নীরব ত্যাগের প্রতীক, সৌন্দর্যের অবয়ব, অথবা সেবাপরায়ণ চরিত্রে পরিণত করা হয়।
ঈদ, যা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ উৎসব এবং পারস্পরিক সহানুভূতি, মানবিকতা ও সমতার বার্তা বহন করে, সেই একই সময়ে আমাদের সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্যকেও সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরে। এখানে দায় নেই উৎসবের, দায় রয়েছে আমাদের সামাজিক কাঠামো এবং মানসিকতায়।
শপিংমলের ঝলমলে আলোয় যেমন থাকে বৈভবের প্রতিফলন, তেমনি ফুটপাথের ধুলোমাখা বেঞ্চে বসে থাকা এক মায়ের মুখে থাকে হিসাবের রেখা- কতটুকু দিতে পারবেন সন্তানের জন্য, আর কাদের ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে যাবে। পিয়েরে বুর্দিয়ুর ‘সিম্বলিক ক্যাপিটাল' ধারণাটি এখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে: ঈদের বাজার হয়ে যায় সেই প্রতীকী সামাজিক প্রতিযোগিতার মঞ্চ, যেখানে কে কতটা প্রদর্শন করতে পারছে, সেটি হয়ে দাঁড়ায় মর্যাদার মাপকাঠি।
উচ্চবিত্তের কাছে ঈদ হয়তো তাদের সক্ষমতার একটি উৎসবায়ন, মধ্যবিত্তের কাছে এটি আত্মপরিচয় ধরে রাখার এক প্রচেষ্টা, আর শ্রমজীবী নারীর কাছে ঈদ মানে নিজের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে সন্তানদের মুখে হাসি দেখানোর এক নীরব সংগ্রাম। এই বৈচিত্র্য আমাদের সমাজের স্বাভাবিক বাস্তবতা। কিন্তু এই বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, উৎসবের প্রকৃত সৌন্দর্য বৈভব নয়; বরং একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতাই এর মূল বার্তা। ঈদ আমাদের শেখায় সমতা এবং সহমর্মিতা। তাই সমাজের প্রতিটি স্তরের নারী যেন সম্মান এবং মর্যাদার সাথে এই আনন্দের অংশ হতে পারে, সেই দিকেই আমাদের সামাজিক ও নীতিগত মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামো, নারীর ভূমিকা এবং ঈদের অন্তঃস্থ সংগ্রাম
বাংলাদেশের সমাজ-সাংস্কৃতিক কাঠামো মূলত পিতৃতান্ত্রিক, যেখানে নারীর পরিচয় প্রায়শই নির্ধারিত হয় পরিবারকেন্দ্রিক ভূমিকার মাধ্যমে- মা, মেয়ে, স্ত্রী বা সেবাদাত্রী। পরিবারের ভেতরে তার শ্রম, ত্যাগ এবং ভালোবাসা মূল্যবান হলেও, সামাজিক বণ্টনের ক্ষেত্রে তাকে প্রান্তিক অবস্থানেই রাখা হয়। উৎসবের আবহে, বিশেষ করে ঈদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে, নারীর ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায় 'সংগঠক' এবং 'অদৃশ্য সেবাদানকারী'। অন্যদের আনন্দ নিশ্চিত করতে গিয়ে সে নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার হিসাব করতে শেখে না। বরং তার স্বার্থ বিলীন হয়ে যায় পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর মধ্যে।
বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় আর্থিক সক্ষমতা প্রায়ই সামাজিক মর্যাদার মানদণ্ড হয়ে ওঠে। ফলে, একজন নারী যখন সীমিত বাজেট হাতে বাজারে যান, তখন তার অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে জটিল। বাজেটের সীমাবদ্ধতা যেন তার স্বপ্ন এবং স্বাতন্ত্র্যের সীমারেখা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি অর্থনৈতিকভাবে কতটা স্বাধীন, সেটির সীমাবদ্ধতা তাকে বিব্রত করে, কিন্তু পরিবারে তার অবস্থান বা ব্যক্তিত্বকে ছোট করে না। অথচ আমাদের সামাজিক মনোভাব নারীর এই সীমাবদ্ধতাকে লজ্জা এবং অপূর্ণতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করতে অভ্যস্ত। এ কারণে নারীর ঈদ মানে হয়ে যায় আত্মত্যাগের আরেক নাম।
সমাজতাত্ত্বিক সারাহ আহমেদের 'affective economies' ধারণাটি এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, সমাজের আবেগীয় চাপগুলো নির্দিষ্ট শরীর ও সত্তার উপর জমা হতে হতে সেই দেহকে ‘অভ্যন্তরীণ বোঝা'তে রূপান্তরিত করে। বাংলাদেশের নারীরা ঈদের সময় এই অভ্যন্তরীণ মানসিক বোঝা বয়ে নিয়ে যান-অর্থনৈতিক অসমতা, সামাজিক প্রত্যাশা এবং সাংস্কৃতিক ‘আদর্শ নারী'-র চাপ মিলিয়ে এক অদৃশ্য যুদ্ধের অংশ হয়ে যান।
যখন একজন মা দেখেন, তার সন্তান অন্যের সন্তানের সমান সুযোগ পাচ্ছে না, তখন তার মধ্যে অপরাধবোধ জন্ম নেয়। কিন্তু এটি তার ব্যর্থতা নয়; এটি একটি বৃহত্তর কাঠামোগত অসাম্য, যেখানে নারীর আর্থিক স্বাতন্ত্র্য সীমিত এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রায়শই অন্যের হাতে। আমাদের সমাজে নারী এখনো ‘সম্পূর্ণ ভোক্তা' নন; তিনি নির্ভরশীল স্বামী, বাবা, বা পরিবারের উপর। ফলে, ঈদের বাজার নারীর জন্য শুধুমাত্র আনন্দের জায়গা নয়, বরং আত্মপরিচয়ের পরীক্ষার মঞ্চ। যেখানে সে সন্তানের মুখে এক ফোঁটা হাসি আনতে নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছা, এমনকি নিজের অস্তিত্বও ম্লান করে দেয়। এই নীরব যুদ্ধের কোনো প্রচার নেই, কোনো ক্যামেরার সামনে আলোকিত মুহূর্ত নেই। আছে শুধু চাপা গ্লানি, আত্মত্যাগ এবং সমাজের নীরব স্বীকৃতি।
সুতরাং, ঈদের এই উজ্জ্বল আড়ালে যে নারীর আত্মত্যাগ লুকিয়ে থাকে, তাকে আমরা যতক্ষণ না সম্মানের চোখে দেখবো, ততক্ষণ সমাজে প্রকৃত সমতা আসবে না। ঈদ শুধু ধর্মীয় আনন্দের উৎসব নয়; এটি হওয়া উচিত সামাজিক সহমর্মিতা ও মর্যাদার চর্চার মঞ্চ, যেখানে প্রতিটি নারী তার সীমাবদ্ধতার ভেতরও মাথা উঁচু করে হাঁটতে পারে।
সাংবাদিকতার নৈতিক দায় ও শ্রেণিসচেতনতা
যে সাংবাদিক ঈদের বাজারে গিয়ে একজন মায়ের কাছে প্রশ্ন করেন, "বাজেট কত?" বা "অন্যরা বেশি খরচ করছে, আপনি কেমন অনুভব করছেন?" তিনি কেবল সংবাদ সংগ্রহ করছেন না; তিনি তার শ্রেণিগত অবস্থানকে ব্যবহৃত করে একজন প্রান্তিক নারীর আত্মসম্মানে আঘাত করছেন। এই ধরনের প্রশ্ন কেবল একটি ‘সংবাদ' সংগ্রহের প্রক্রিয়া নয়; এটি নারীর অভ্যন্তরীণ চাপ এবং পরাজিত অনুভূতির গভীরে গিয়ে, তাকে অপমানিত করার প্রচেষ্টা। সাংবাদিকতা একটি শ্রেণিসচেতন পেশা হওয়া উচিত, যেখানে প্রতিটি প্রশ্নের পেছনে শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ নয়, বরং শ্রদ্ধা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ থাকা প্রয়োজন।
বোর্ডিয়ুর ‘symbolic violence' তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রতিটি ভাষা, প্রশ্ন এবং উপস্থাপনা ক্ষমতার প্রতিফলন। ভাষার শক্তি নির্ধারণ করে আমাদের সম্পর্ক, বিশ্বাস এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের মৌলিক কাঠামো। যখন সাংবাদিকতার ভাষা ক্ষমতার বাহক হিসেবে কাজ করে, তখন তা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষমতার প্রদর্শন হয় না, বরং সমাজের বিদ্যমান শ্রেণিবৈষম্যকে আরো দৃঢ় করে তোলে। এই ক্ষমতার ব্যবহারের মধ্যে, যিনি প্রশ্ন করছেন, তিনি নিজের শ্রেণিসামাজিক অবস্থানকে প্রাধান্য দিচ্ছেন এবং সেই অনুযায়ী প্রান্তিক নারীকে ‘নীরব' করতে চাচ্ছেন। এটি এমন এক অবিচ্ছেদ্য কৌশল, যা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীর কণ্ঠরোধ করার একটি ধ্বংসাত্মক এবং অসাম্যমূলক প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে।
এই প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে একজন নারী যেমন তার শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক অবস্থানকে পুনরায় অনুভব করেন, তেমনি সে তার মৌলিক সম্মান এবং মর্যাদার অভাবও বুঝতে পারে। যে সাংবাদিক এসব প্রশ্ন করেন, তিনি নিজে হয়ে উঠেন শ্রেণি-আধিপত্যের প্রতিনিধি, যেখানে নারীর অনুভূতি বা বাস্তবতা কেবল একটি পরিসংখ্যান, আর তার অনুভূতিকে অগ্রাহ্য করা হয়।
জাকাত এবং দানের সামাজিক ও শ্রেণিগত রাজনীতি
জাকাত ইসলামিক সমাজের ন্যায় ও সমতার এক মহান ধারণা। এটি সমাজের অর্থনৈতিক দুর্বল শ্রেণির প্রতি সহানুভূতির এবং সমানাধিকারের লক্ষণ। তবে বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়া আজকাল এক ধরনের শ্রেণি প্রদর্শন হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে জাকাত এবং দানকে সামাজিক মর্যাদার প্রদর্শন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখানে দান কেবল ভালোবাসা এবং সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এটি এক সামাজিক "প্রতিষ্ঠা" হয়ে দাঁড়ায়। দাতার প্রতি সমাজের প্রশংসা এবং তার সামাজিক অবস্থানের স্বীকৃতির এক প্রক্রিয়া।
অভিজাত সমাজের মানুষ যখন জাকাত প্রদান করেন, তখন তা সাধারণত সামাজিক মিডিয়াতে প্রচারিত হয়। এই প্রদর্শন শুধু একটি দানের ঘটনা হয়ে থাকে না, বরং এটি একজনের শ্রেণিগত অবস্থান এবং সমাজে তার মর্যাদার প্রকাশ ঘটে। কিন্তু, সেই দানগ্রহীতা নারীটির চোখে থাকে দানের সঙ্গে জড়িত লজ্জা এবং শ্রদ্ধার অভাব। তিনি জানেন, যে কাপড় বা সামান্য খাদ্যসামগ্রী তিনি নিচ্ছেন, তা এক ধরনের ‘করুণা', মর্যাদা নয়। এই করুণা তাকে না চাইতেও তার সামাজিক অবস্থানকে আরও নিচু করে তোলে।
এমন দানের মাধ্যমে আমাদের সমাজে এক ধরনের দ্বিমুখী ধারণা সৃষ্টি হয়, একদিকে দান করা, অন্যদিকে দানগ্রহীতা ব্যক্তি তার অবস্থান ও আত্মসম্মান হারানোর আশঙ্কায় থাকেন। এই সমাজে যাকাতের আসল উদ্দেশ্য, অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করা, তা অনেক সময় ভুলভাবে বাস্তবায়িত হয়। ‘প্রতীকী দান' সৃষ্টির মাধ্যমে যে শ্রেণি-ভেদাভেদ দৃঢ় হচ্ছে, তা আমাদের সমাজে এক নতুন ধরনের অবিচারের জন্ম দিচ্ছে, যেখানে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির কর্তৃত্ব বজায় থাকে এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণি নিজের মর্যাদাহীনতার বোঝা বহন করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মিডিয়ার শ্রেণিমুখী সহিংসতা
বর্তমান সময়ে মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা একটি দ্বিমুখী প্রকৃতির। একদিকে, এটি মানুষের জীবনের বাস্তব অভ্যন্তরীণ অবস্থা এবং তাদের বাস্তবিক পরিস্থিতির একটি প্রতিবিম্ব হতে
পারে; কিন্তু অন্যদিকে, এটি একটি ‘বিনোদনমূলক দারিদ্র্য দর্শন' (poverty pornography) হিসেবেও কার্যকর হয়ে উঠছে। এখানে নারীর দুঃখ এবং সংগ্রাম হয়ে দাঁড়ায় ‘ব্র্যান্ড' বা ‘ভিউ' কুড়ানোর উপকরণ। নারীকে নিয়ে ট্রল করা, অপমানজনক কনটেন্ট তৈরি করা এবং হাসির খোরাক হিসেবে পরিণত হওয়া শুধু এক ধরনের শোষণ নয়, বরং এটি আমাদের সমাজের শ্রেণী বৈষম্য এবং নারীর প্রতি বিদ্বেষের সংকটকে আরও প্রবল করে তোলে। নিম্নবিত্তের যন্ত্রণা, প্রান্তিক নারীর হতাশা এবং তাদের চোখের জল প্রিয় কনটেন্ট হিসেবে পরিণত হয়, যা আমাদের মানবিকতা এবং মর্যাদার প্রতি এক বড় আঘাত।
অথচ সাংবাদিকতার, বিশেষ করে মিডিয়ার দায়িত্ব হলো এই গল্পগুলিকে শ্রদ্ধা, সংবেদনশীলতা এবং শ্রেণিসচেতনতার সাথে তুলে ধরা, যেখানে নারীর আত্মত্যাগের গল্প, তার সংগ্রাম এবং মর্যাদার পুনরুদ্ধারের আহ্বান থাকে। কিন্তু বাস্তবে, আমরা যখন ‘বাজেট' বা ‘অন্যদের চেয়ে কম কেনাকাটা' নিয়ে হাস্যকর কনটেন্ট তৈরি করি, তখন সেটি নারীর অবস্থান এবং বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত গভীরতর নৈতিক সংকটের বিষয়টি মুছে ফেলতে সাহায্য করে।
সমাজের কাঠামোগত অসাম্য এবং নারীর নীরব কান্না
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামগ্রিক জিডিপি বৃদ্ধি যতই উন্নতির ইঙ্গিত দেয়, ততই সমাজের কাঠামোগত অসাম্য এবং বিশেষ করে নারীর অবস্থান সেই উন্নতির আড়ালে চাপা পড়ে থাকে। প্রতিটি নারী মায়ের চোখে অদৃশ্য এক কান্নার কাহিনী লুকানো থাকে, যা আমাদের সম্মান এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করে। ঈদের বাজারে দাঁড়িয়ে যিনি পরিবারের জন্য সামান্য কিছু কেনার চেষ্টা করছেন, তার চোখে থাকে কেবল সীমিত অর্থের জন্য চাপ এবং সন্তানের জন্য অভাবের অস্বস্তি।
এই পরিস্থিতি যে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, বরং একটি বৃহত্তর সামাজিক অসাম্যের প্রতিবিম্ব, তা বোঝা অত্যন্ত জরুরি। সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণি যেখানে বাজারে নির্বিঘ্নে কেনাকাটা করতে পারে, সেখানে নারী, বিশেষত নিম্নবিত্ত বা শ্রমজীবী নারী ঈদকে একটি সংগ্রামের সময় হিসেবে দেখে। তার কাছে ঈদ মানে শুধু অর্থের সীমাবদ্ধতা নয়; এটি নিজের মর্যাদা এবং সামাজিক সম্মানের জন্য এক অদৃশ্য যুদ্ধ।
অর্থনৈতিক অসাম্য যখন সামাজিক কাঠামোর ভিতর থেকে চলে আসে এবং প্রতিটি সমাজের নারীর জীবনে পরিণত হয় একটি চাপের যন্ত্রণা, তখন সেটি অন্যায়ের একটি বড় চিহ্ন। নারী যখন নিজের সীমিত অর্থের মধ্যে সন্তানের মুখে হাসি আনতে চেষ্টা করেন, তখন এটি কেবল তার চাওয়ার অভাব
নয়, বরং সামাজিক কাঠামোর সেই প্রতিফলন যা তার জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার এবং সামাজিক মর্যাদা সীমিত করে রেখেছে। সমাজের এ কাঠামোগত অসাম্য কেবল ‘অর্থনৈতিক' নয়, এটি একটি ‘মনস্তাত্ত্বিক' দুঃখও হয়ে ওঠে, যা নারীর ভেতরে একটি গভীর অপরাধবোধ তৈরি করে, সমাজে ‘অন্যদের' কাছে নিজের অবস্থান এতটুকু পরিবর্তন করতে না পারা।
শেষ কথা: পরিবর্তনের আহ্বান
নারীর চোখের কান্না কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতার প্রতিফলন নয়; এটি আমাদের সমাজের কাঠামোগত বৈষম্যের সুর। ঈদের আনন্দ তাই শুধুমাত্র আমোদ নয়; এটি সামাজিক দায়, শ্রেণিচেতনাবোধ এবং সম্মানের জায়গা। সাংবাদিকদের দায়িত্ব সেই নীরব কান্না শোনা এবং তা সঠিক প্রেক্ষাপটে বলা। এবং আমাদের সবার দায়িত্ব, ঈদকে কেবল প্রদর্শনের উৎসব হিসেবে না দেখে, সমাজের প্রান্তিক মানুষের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে তোলা। সামাজিক সহানুভূতি এবং শ্রেণিসচেতনতার সেই শিক্ষা না এলে, প্রতিবার ঈদেই কোনো এক মায়ের মুখে থাকবে চাপা হাসির আড়ালে অশ্রু, আর আমরা সেই অশ্রু দিয়ে তৈরি করবো কনটেন্ট , এটি হবে আমাদের সভ্যতার লজ্জা।
ডি ডব্লিউ