রোববার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. দার
মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা চালানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা, সম্পদের সুষম বণ্টন সহ ঊনিশশো একাত্তর সালের যেসব অমীমাংসিত বিষয়ের কথা বাংলাদেশ বলছে, সেগুলো আগেই দু'দফায় সমাধান হয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার।
তিনি এখন ঢাকা সফরে রয়েছেন। তিনি মন থেকে অতীতের স্মৃতি মুছে ফেলে দু'দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন।
"পরিবারের মধ্যে, ভাইদের মধ্যে যখন এটার সমাধান হয়ে গেছে, এমনকি ইসলামও আমাদের বলেছে যে, তোমাদের হৃদয় পরিষ্কার করো," রোববার ঢাকায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। "সুতরাং চলুন সামনে এগিয়ে যাই। আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, আমাদের ভবিষ্যত উজ্জল," বলেন মি. দার।
এর আগে, দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের শেষদিন আজ সকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সেখানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি ও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। "আজ মোট ছয়টি দলিল সাক্ষরিত হয়েছে এবং আমি মনে করি, এটি দারুণ একটি সূচনা," সাংবাদিকদের বলেন মি. দার।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সঙ্গে বৈঠক করার আগে সকালে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গেও বৈঠক করেন বাংলাদেশে সফররত পাকিস্তানের এই নেতা। এসব বৈঠকে দু'দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরও দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কিছু সমস্যা অমীমাংসিতই রয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
সেগুলোর মধ্যে প্রধান তিনটি ইস্যু হলো: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চালানো গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা, স্বাধীনতার সময়কার পাকিস্তানের সম্পদের সুষম বণ্টন এবং দু'দেশের আটকে পড়া নাগরিকদের প্রত্যাবাসন।
এসব বিষয় নিয়ে অতীতে বিভিন্ন সময় দু'দেশের মধ্যে নানান আলাপ-আলোচনা হতে দেখা গেলেও দৃশ্যমান কোনো সমাধান দেখা যায়নি।
শনিবার পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দারের দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় অবতরণ করলে নতুন করে ইস্যুগুলো সামনে আসে এবং সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন মহল থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়।
কিন্তু রোববার সকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন যে, দু'দেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো অতীতে দু'দফায় সমাধান করা হয়েছে।
"(অমীমাংসিত) ইস্যু দু'বার নিষ্পত্তি করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে, এরপর ২০০০ সালের গোড়ার দিকে যখন জেনারেল (পারভেজ) মোশাররফ এখানে এসেছিলেন এবং তিনি গোটা পাকিস্তান জাতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে কথা বলেছিলেন," সাংবাদিকদের বলেন মি. দার।
১৯৭৪ সালে অমীমাংসিত বিষয়ের আনুষ্ঠানিক সমাধান হয়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, ঐতিহাসিক সেই দলিলপত্র দুই দেশের কাছেই রয়েছে।
"আমি মনে করি এখন ইসলাম ধর্ম, পবিত্র কোরআন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র হাদিসে যেমনটা বলেছেন, সেভাবে আমাদের নতুন করে শুরু করে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা একটা পরিবার এবং আমাদের একসঙ্গে কাজ করা উচিৎ," বলেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী মি. দার।
ইতিহাস কী বলে?
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার দুই বছরেরও বেশি সময় পর ১৯৭৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল পাকিস্তান।
এ ঘটনার মাত্র চার মাসের মাথায় শতাধিক ব্যক্তির বিশাল এক বহর নিয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো।
সেই সফরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনায় "তওবা" বা অনুশোচনা প্রকাশ করে সেটির জন্য এককভাবে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসকদের দায়ী করেন মি. ভুট্টো।
বিষয়টিকে "বেদনাদায়ক" বর্ণনা করে সেটির ইতি টেনে তখন দু'দেশের মধ্যে "স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বসুলভ" সম্পর্ক স্থাপনের আহ্বানও জানিয়েছিলেন তিনি।
ঢাকায় মি. ভুট্টো বলেছিলেন, "যা হয়েছে তা নিয়ে অন্তর থেকে অনুতপ্ত হতে বা তওবা করতে দেরি হয়ে যায়নি। পাকিস্তানের মানুষ আপনাদের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানায়। তারা এবং পাকিস্তানের সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করে এবং শ্রদ্ধা জানায়।"
১৯৭৪ এর এপ্রিলের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার ত্রিপাক্ষিক চুক্তির বিবরণেও রয়েছে যে, জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা তাদের (পাকিস্তানকে) ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যান।
শেখ মুজিবুর রহমানের তরফ থেকেও অতীত ভুলে নতুন সূচনা করার এবং "ক্ষমার নিদর্শন হিসেবে বিচার না চালানোর" সিদ্ধান্তের কথার উল্লেখ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি আর্কাইভ প্রতিবেদনে।
এরপর ২০০২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশাররফ বাংলাদেশ সফরে এসে পুনরায় দুঃখ প্রকাশ করেন।
তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার অবিভক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ভাগ চাওয়া হলেও পাকিস্তানের কোনো সরকারই সেটি বুঝিয়ে দেননি।
এমনকি ১৯৭৪ সালে বিষয়গুলো নিয়ে মি. ভুট্টোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।
বিশেষত দায় ও সম্পদের বন্টন প্রশ্নে পাকিস্তান অযৌক্তিক মনোভাব প্রকাশ করার কারণে আলোচনা ভেস্তে গেছে বলে সে সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। ফলে বিষয়টি এখনও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
"একাত্তর সালে এখানে গণহত্যার দায়, পাকিস্তানিদের এই দায়টা স্বীকার করতে হবে এবং সেটার জন্য আকারে ইঙ্গিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে তারা বলেছে। কিন্তু আমরা চাই যে, তারা এই দায়িত্বটা নিয়ে প্রকাশ্যে এর একটা সমাধান করুক," বিবিসি বাংলাকে বলেন বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির।
এর আগে,এ বছরের গত ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে 'মুক্তিযুদ্ধে নৃশংসতার জন্য ক্ষমা কিংবা স্বাধীনতাপূর্ব অভিন্ন সম্পদের জন্য বকেয়া অর্থ দাবির' মতো বিষয় ফলাও করে প্রচার করা হয়।
এছাড়া স্বাধীনতাপূর্ব ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের কাছে চার দশমিক তিন দুই বিলিয়ন বা ৪৩২ কোটি ডলার চেয়েছে বলেও তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।
"আমরা বলেছি, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা পাকিস্তানের সাথে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়সমূহের দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির মাধ্যমে একটি মজবুত, কল্যাণমুখী ও ভবিষ্যৎমুখী সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানের সহযোগিতা কামনা করি এবং এই লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছি," পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
কী কী চুক্তি ও সমঝোতা হলো?
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে রোববার একটি চুক্তি সই করা হয় বলে জানিয়েছেন উভয় দেশের কর্মকর্তারা।
এর মধ্যে দু'দেশের সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা বিলোপ করে একমাত্র চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
"এর ফলে এখন থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের (একে অন্যের দেশে যাওয়ার জন্য) কোনো ধরনের ভিসা নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না," চুক্তি শেষে রোববার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার।
চুক্তির পাশাপাশি বৈঠকে আরও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছেন দু'দেশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যবিষয়ক যৌথ কমিটি গঠনে একটি সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে।
এর বাইরে, দু'দেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা, রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সঙ্গে পাকিস্তানের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইসলামাবাদের (আইএসএসআই) সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সংস্কৃতিবিনিময়ে একটি আলাদা কর্মসূচি গ্রহণের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।