শুক্রবার রাতে ঢামেক থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে শরিফ ওসমান হাদিকে।
মোটরসাইকেলে ছিলেন হেলমেট পরা দুই ব্যক্তি। মোটরসাইকেল চালানো ব্যক্তিটির পরনে ছিল জিনসের প্যান্ট এবং পেছনের আসনে বসা ব্যক্তির গায়ে চাদর ছিল। একপর্যায়ে মোটরসাইকেলটি অটোরিকশার কাছে পৌঁছানোর পর পেছনে বসা ব্যক্তি আগ্নেয়াস্ত্র বের করে গুলি চালায়
রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট সড়কে মাথায় গুলিবিদ্ধ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রাজধানীর এভারকেয়ারে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পরিবারের সিদ্ধান্তে তাঁকে ওই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হাদি ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আজ দুপুরে বিজয়নগরে তাঁকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। মাথায় গুলিবিদ্ধ হাদিকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
আজ শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা মেডিকেল থেকে হাদিকে নিয়ে যাত্রা করে অ্যাম্বুলেন্স। রাত ৮টা ৬ মিনিটে অ্যাম্বুলেন্সটি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে পৌঁছায়।

ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থা নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘তাঁর মাথায় বুলেটের আঘাত আছে। বুকে ও পায়েও আঘাত আছে। ধারণা করা হচ্ছে পায়ের আঘাতটা রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে হতে পারে। আমরা ঢাকা মেডিকেলে একটা প্রাথমিক সার্জারি (অস্ত্রোপচার) করেছি।’
আসাদুজ্জামান জানান, পরিবারের সম্মতিতেই ওসমান হাদিকে এভারকেয়ারে নেওয়া হয়। পরিবার প্রথম দিকে সিএমএইচ হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এভারকেয়ারে নেওয়ার কথা বলে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, বেলা ২টা ২৫ মিনিটে একটি মোটরসাইকেলে দুর্বৃত্তরা আসে। মোটরসাইকেল থেকে হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির পেছনের রিকশায় ছিলেন মো. রাফি। তিনি ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দেন।
মো. রাফি বলেন, ‘জুমার নামাজ শেষে আমরা হাইকোর্টের দিকে আসছিলাম। রিকশায় ছিলাম। বিজয়নগরে আসতেই একটা মোটরসাইকেলে করে দুজন এসে হাদি ভাইয়ের ওপর গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়। আমি ভাইয়ের পেছনের রিকশায় ছিলাম।’

এদিকে দুর্বৃত্তদের গুলিতে ওসমান হাদির গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দ্রুত ও ব্যাপক তদন্ত চালিয়ে হামলায় জড়িত সবাইকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন।
হাদিকে গুলির ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজে যা পাওয়া গেল
সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার জুমার নামাজের পরে তুলনামূলক ফাঁকা রাস্তায় একটা–দুইটা গাড়ি চলছে। হঠাৎ গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন আশপাশের লোকজন। এ সময় ভেসে আসে ‘বাঁচাও’, ‘বাঁচাও’ বলে একজনের চিৎকার। ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে চিৎকার করছিলেন তিনি। তাঁর রিকশাটি থামানো হলে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির মাথা ও কান থেকে রক্ত গড়িয়ে রাস্তায় পড়ছে।
শুক্রবার বেলা ২টা ২৪ মিনিটে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট সড়কে গুলিবিদ্ধ ওই ব্যক্তি ছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি। তাঁর মাথায় গুলি লেগেছে। গুরুতর অবস্থায় হাদিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসার পর তাঁকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ওসমান হাদি গত বছর গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচনায় আসেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঢাকা–৮ আসনে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। করছিলেন গণসংযোগও।
দুপুরে চলন্ত ব্যাটারিচালিত রিকশায় বসে থাকা অবস্থায় হাদিকে যখন গুলি করা হয়, সে সময় ওই রাস্তার পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়েছিলেন সাজ্জাদ খান নামের এক ব্যক্তি। তাঁর সামনেই ওসমান হাদিকে যেভাবে গুলি করা হয়েছে, সেই ঘটনার বর্ণনা প্রথম আলোর কাছে তুলে ধরেছেন তিনি।
সাজ্জাদ খান জানান, তিনি ঘটনাস্থলের পাশের একটি ভবনে চাকরি করেন। পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট সড়কে বাইতুস সালাহ জামে মসজিদে জুমার নামাজ শেষে বেরিয়ে তিনি মসজিদের উল্টো দিকের ‘ডক্টর টাওয়ার’ নামের একটি বহুতল ভবনের সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় তাঁর পরিচিত ও অপরিচিত অনেকেই ফুটপাতে ছিলেন।
সাজ্জাদ খান বলেন, ওসমান হাদি ফকিরাপুলের দিক থেকে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়ে পশ্চিম দিকে বিজয়নগরে যাচ্ছিলেন। রিকশায় তাঁর পাশের আসনে আরেকজন ছিলেন। একটি মোটরসাইকেলে দুই ব্যক্তি ওই অটোরিকশার পিছু নিয়ে তাঁদের অনুসরণ করছিলেন। মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ব্যক্তির গায়ে কালো একটি চাদর ছিল। ওই চাদর দিয়ে তাঁর হাত দুটি ঢাকা ছিল। তাঁদের মোটরসাইকেল অটোরিকশার বরাবর এলে পেছনে বসা ওই ব্যক্তি একটি আগ্নেয়াস্ত্র বের করে খুব কাছ থেকে চলন্ত রিকশায় থাকা হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। মুহূর্তের মধ্যে এ ঘটনা ঘটিয়ে তাঁরা মোটরসাইকেলে করে বিজয়নগরের দিকে চলে যান।
গুলির শব্দে রাস্তায় থাকা লোকজন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান উল্লেখ করে সাজ্জাদ খান বলেন, এ সময় সবার মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন হাদি ‘বাঁচাও’, ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেন। এ পর্যায়ে রিকশাটি থামানো হলে সবাই এসে ভিড় করেন। এ সময় হাদির মাথা ও কান থেকে রক্ত গড়িয়ে রাস্তায় পড়ছিল। রিকশায় তাঁর পাশে থাকা লোকটি হাদিকে ধরে রাখেন। এরপর তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঘটনার পর পুলিশ, র্যাব, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় সেনাবাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ডক্টর (ডিআর) টাওয়ারে স্থাপিত সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে হামলাকারীদের শনাক্তের কাজ শুরু করেন।
ওই ফুটেজে দেখা যায়, একটি মোটরসাইকেলের দুই আরোহী পেছন থেকে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশাকে অনুসরণ করছেন। রিকশায় দুজন যাত্রী ছিলেন। আর মোটরসাইকেলে ছিলেন দুই ব্যক্তি। তাঁদের দুজনেরই হেলমেট পরা ছিল। মোটরসাইকেল চালানো ব্যক্তিটির পরনে ছিল জিনসের প্যান্ট এবং পেছনের আসনে বসা ব্যক্তির গায়ে চাদর ছিল। একপর্যায়ে মোটরসাইকেলটি অটোরিকশার কাছে পৌঁছানোর পর পেছনে বসা ব্যক্তি আগ্নেয়াস্ত্র বের করে গুলি চালান।
বিকেলে বক্স কালভার্ট রোডে ঘটনাস্থলে গিয়ে সাংবাদিক ও উৎসুক মানুষের ভিড় দেখা যায়। ঘটনাস্থলের রাস্তায় ছোপ ছাপ রক্তের দাগ। সিআইডির অপরাধ শনাক্তকরণ দল হলুদ ফিতা দিয়ে ঘটনাস্থলটি ঘিরে রেখেছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কর্মকর্তাসহ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কাজ করছেন। পাশেই অবস্থান নিয়েছে সেনাবাহিনী।

সিআইডির অপরাধ শনাক্তকরণ দলের পরিদর্শক আবদুর রশীদ উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা ঘটনাস্থলের তিন জায়গা থেকে রক্তের আলামত সংগ্রহ করেছেন। এখানকার আলামত যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য ঘটনাস্থলটি হলুদ ফিতা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশের মতিঝিল অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার হোসাইন মোহাম্মদ ফারাবী বলেন, ডক্টর টাওয়ারসহ একাধিক ভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হামলাকারীদের শনাক্ত করতে পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। কারা কেন ওসমান হাদিকে গুলি করেছে, সে বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি।
হাদিকে গুলিবর্ষণে তারেক রহমানের নিন্দা
ঢাকায় ইনকিলাব মঞ্চের নেতা ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দেশ এখন অত্যন্ত সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী প্রতিটি দল ও ব্যক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন আজ শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগরে ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লন্ডন থেকে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে এ কথা বলেন তারেক রহমান। বিকেলে ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ শীর্ষক ওই অনুষ্ঠান হয়।
এ প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা দেখেছি গত এক বছরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা হুমকি দিয়েছে প্রকাশ্যে যে প্রত্যাশিত নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে, সে নির্বাচনকে তারা হতে দেবে না, বাধাগ্রস্ত করবে।’ একটি দল, গোষ্ঠী বা কিছু ব্যক্তি এই দেশকে দেশের মানুষের শান্তি স্থিতিশীলতা বিনষ্টের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

হাদির ওপর এ হামলা ষড়যন্ত্রের অংশ উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘যারা এই দেশের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করতে চায়, এ দেশের সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করে, এই দেশের স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করতে চায়, তারা তাদের ষড়যন্ত্র যে শুরু করে দিয়েছে, আজকে ওসমান হাদির ঘটনা দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে।’ কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে একইভাবে বিএনপির আরেক প্রার্থীকে গুলি করা হয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এই পরিস্থিতিতে জাতীয়তাবাদী শক্তির সর্বোচ্চ ঐক্যের প্রয়োজন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘এ কারণেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং একই সঙ্গে যাঁরা বাংলাদেশের অস্তিত্বে, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করেন, দল ছোট-বড় বিষয় না, যারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অস্তিত্বে, বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, সবার আগে বাংলাদেশ—এই নীতিতে যারা বিশ্বাস করে, আমাদের প্রত্যেকটি দল প্রত্যেকটি নেতা প্রত্যেকটি কর্মী প্রত্যেকটি মানুষকে আজ অতীতের যেকোনো সময় থেকে সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
