আগেরবার লন্ডনে চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়া দেশে ফেরার প্রাক্কালে বিমানবন্দরে মা-ছেলে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরছেন না। মা বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন নিয়ে যেতে তারেক রহমানে স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান আজ বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে।
প্রায় দুই দশক থেকে আলোচনায় থাকা ‘মাইনাম টু’ ফর্মুলা এখন আরো পরিণত হয়ে ‘মাইনাস টু ফ্যামেলি’ বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন নেয়ার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হওয়ার পর এই আলোচনা এখন রাজীতির অন্দরমহল থেকে গ্রামে-গঞ্জে চায়ের দোকান পর্যন্ত চলে গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনা ভারত চলে যাওয়ার প্রায় ১৬ অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তারেক রহমান দেশে ফিরতে না পারা, এমনকি মা বেগম খালেদা জিয়া মৃত্যুশয্যায় থাকার পরও দেশে ফিরতে না পারার কারণ হিসাবে অদৃশ্য বাধার ইঙ্গিত দেন। যা বিএনপি নেতা-কর্মিদের চরম হতাশায় নিমজ্জিত করেছে।

দায়িত্বশীল সুত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত নির্ধারিত সময়েই জাতীয় নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। ফলে নির্বাচনের আগে তারেক রহমানের দেশে ফেরা কিংবা নির্বাচনে অংশ নেয়া অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তবে দল হিসাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বিএনপি ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণে বিএনপির নির্বাচনী প্রচার কিছুটা স্থবির হলেও জামায়াত-চরমোনাই জোট সারাদেশে ব্যাপকভাবে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
ঢাকায় একাধিক রাজনীতিকে সঙ্গে আলাপকালে তারাও শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, শেখ হাসিনা কিংবা তার পরিবারের কোনো সদস্য আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখন মনে হচ্ছে খালেদা জিয়ার পরিবারকেও মাইনাসের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশি-বিদেশি একটি মহল কাজ করছে।

বিএনপি সুত্র জানিয়েছে, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নিতে যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সময় আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের পথে রওনা হচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমান। এদিকে খালেদা জিয়াকে নেওয়ার জন্য কাতারের আমিরের যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আজ রাতে ঢাকায় আসার কথা ছিল, সেটা আসতে বিলম্ব হচ্ছে।
কাতারের আমিরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আজ রাতে ঢাকায় পৌঁছাবে—আজ বিকেলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ কথা বলেছিলেন। তবে সন্ধ্যার পর দলটির মিডিয়া উইং জানিয়েছে, এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে কিছু টেকনিক্যাল (কারিগরি) সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ কারণে এর যাত্রা বিলম্বিত হবে।
অবশ্য বিএনপির সূত্র বলছে, এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় পাঠানোর জন্য দ্রুত প্রস্তুত না হলে কাতার কর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিতে বিকল্প ব্যবস্থা করার কথাও চিন্তা করছে।

লন্ডনের স্থানীয় সময় আজ সন্ধ্যায় (বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী প্রায় মধ্যরাত) জুবাইদা রহমান ঢাকার উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন বলে বিএনপির সূত্রগুলো জানিয়েছে। তারা বলছে, আগামীকাল শুক্রবার দিনের প্রথমার্ধে তিনি ঢাকায় পৌঁছাতে পারেন। পরে শাশুড়িকে দেখতে সরাসরি ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে যেতে পারেন জুবাইদা রহমান। খালেদা জিয়ার সঙ্গে লন্ডনযাত্রায়ও শরিক হতে পারেন চিকিৎসক জুবাইদা।
মাইনাস টু থেকে মাইনাস ফোর—বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন শঙ্কা
সম্প্রতি বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ১৫ মাস পেরিয়ে গেলেও তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। আওয়ামী লীগ আমলসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার সব মামলায় তিনি ও তাঁর স্ত্রী জুবাইদা রহমান আইনি প্রক্রিয়ায় অব্যাহতি পেয়েছেন। নিরাপত্তার জন্য দুটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনা এবং অস্ত্রের লাইসেন্স আবেদনের তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ায় আইনি বা নিরাপত্তাজনিত বাধা নেই বলেই মনে করা হচ্ছিল। তবু বাস্তবে তার দেশে ফেরা ঝুলে আছে।

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনে প্রভাবশালী কিছু দেশের আপত্তি থাকতে পারে। তবে কোন দেশ, কীভাবে এবং কেন আপত্তি জানিয়েছে—এ বিষয়ে তারা নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, তারেক রহমানের সাম্প্রতিক ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকেই বোঝা যায় দেশে ফেরা তার একার সিদ্ধান্ত নয়; বিষয়টির সঙ্গে এমন কিছু শক্তি যুক্ত আছে যা তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
মহিউদ্দিন আহমেদের মতে, উইকিলিকস ফাঁসে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির বিষয়টি আগেই প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি বলেন, “ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে পরিবর্তন না হলে তারেক রহমান কোন ভরসায় দেশে ফিরবেন? বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতা অনেকটাই এ দুই দেশের অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল।” তিনি আরও মনে করিয়ে দেন, ১/১১–এর সময় তারেক রহমানের দেওয়া মুচলেকা, খালেদা জিয়ার সেই মন্তব্য যে তিনি আর রাজনীতি করবেন না—এই অঙ্গীকারগুলোর স্থায়িত্ব আজও পরিষ্কার নয়।

এদিকে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় অভিযোগ করেন, দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব পাল্টাতে অগণতান্ত্রিক তৎপরতা চলছে। তার এই মন্তব্য এবং তারেক রহমানের ফেসবুক পোস্ট একসঙ্গে আলোচনায় এনেছে পুরনো ‘মাইনাস টু’ তত্ত্বকে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাকেই ‘মাইনাস টু’ বলা হতো। তবে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাস্তবে এজেন্ডা ছিল ‘মাইনাস ফোর’—দুই রাজনৈতিক পরিবারের ধারাবাহিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পনা। তার ভাষায়, “একটি পরিবারের (শেখ হাসিনা পক্ষ) ‘মাইনাস’ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। খালেদা জিয়া অসুস্থতার কারণে নিষ্ক্রিয়। ফলে বাকি থাকলেন তারেক রহমান। তার দেশে ফেরার অনিশ্চয়তা শেষ পর্যন্ত ঘটনাকে মাইনাস ফোর–এ নিয়ে যায় কি না তা সময়ই বলবে।”
