প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সুফিউর রহমান
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে শেখ হাসিনার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ধারণা সুফিউর রহমানের মাথায় আসে। তিনি তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিবের মাধ্যমে শেখ হাসিনার কাছে এই খবর পৌঁছে দেন # চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে গণঅভ্যূত্থানের দুই মাস আগ পর্যন্তও জাতিসংঘে সরকারের গুম-খুন ডিফেন্ড করেছেন # এমন ব্যক্তিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী দায়িত্ব প্রদান যথেষ্ট উদ্বেগের
ডব্লিউ রাহমান
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় বিশেষ সহকারী হিসেবে রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সুফিউর রহমানকে নিয়োগদান করেছেন। রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬ অনুযায়ী উপদেষ্টাকে সহায়তার জন্য সুফিউর রহমানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। যিনি ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়া পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি বিশ্বস্থ এবং ঘনিস্ট হিসাবে পরিচিত। শেখ হাসিনা তাহাকে একের পর এক শুধু তিন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধিই করেননি, স্বাভাবিক অবসরের পরও চু্ক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার তথা শেখ হাসিনার গুম-খুনের পক্ষে জাতিসংঘে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ডিফেন্ড করার কারণে তিনি এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। গণঅভ্যূত্থানের মাত্র দুই মাস আগ পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘে শেখ হাসিনার চুক্তিভিত্তিক প্রতিনিধি হিসাবে গুম-খুন ডিফেন্ডের দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় ফ্যাসিবাদের সহযোগি এমন ব্যক্তিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী দায়িত্ব প্রদান করায় উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সুফিউরকে আমি চিনি চাকরির প্রথম দিন থেকেই। উত্তর বাংলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা এক অমার্জিত ছেলে, যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছে।
চাকরির শুরু থেকেই তার সম্বল ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার সুবিধা গ্রহণ করা, মানবিকতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া, লোক দেখানো গরিবী আর সততাকে উপরে তুলে ধরা। বুয়েটে পড়ার কারণে তার ইংরেজি ছিল দুর্বল এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক জ্ঞান ছিল সীমাবদ্ধ। তবে এটাও সত্য যে, তিনি চেষ্টা করতেন। আমি বহুবার তাকে দেখেছি একাডেমিতে, এমনকি পোস্টিংরত অবস্থায় খালি গায়ে লুঙ্গি পরে অতিথিদের সাথে কথা বলতে। সুফিউরকে নিয়ে কথা বলার কারণ হলো, আমাদের অনেক জুনিয়র কূটনীতিক মোজাম্মেল হক পিটার-এর একটি সুদীর্ঘ লেখা নজরে এসেছে। তার দীর্ঘ লেখাটি আমি পড়েছি এবং পড়ে আমার ধারণা হয়েছে, হয় মোজাম্মেল এখনো হয়ত সুফিউরকে ঠিকমতো চিনতে পারেননি, অথবা তিনি তার ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই এই লেখাটি লিখেছেন। এই বক্তব্যমালার কারণগুলো একে একে আমার লেখায় আসবে।
মোজাম্মেলের লেখার মূল বক্তব্য হলো—সুফিউর কখনো কোনো সরকারের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেননি এবং সব সরকারের সাথেই সমানভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এটি কেবল একজন সুবিধাভোগী স্বার্থান্বেষীর পক্ষেই সম্ভব। তবে এটার জন্য আমি সুফিউরকে দোষ দিই না। অধিকাংশ মানুষই এরকম করার চেষ্টা করেন। আমি সুফিউরকে যে কারণে ক্ষমা করতে পারি না, তা হলো—তার মাধ্যমে বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৬ সালে মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন তিনি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি এ সম্পর্কে সরকারকে আগাম কোনো তথ্য দিতেও পারেননি। উপরন্তু, এই ঘটনা ঘটার পরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ধারণা তার মাথায় আসে। তিনি তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিবের মাধ্যমে শেখ হাসিনার কাছে এই খবর পৌঁছে দেন। যে কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর কোন চেষ্টা সরকার করেনি। যার পুরস্কারস্বরূপ তাকে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দায়িত্ব পরিবর্তিতে তিনি জাতিসংঘের প্রধান শরণার্থী সংস্থা UNHCR-কে না দিয়ে অন্যান্য সুবিধা আদায়ের জন্য IOM-কে দেন।
সবচেয়ে দুঃখের কথা, পরাজিত সৈনিক হিসেবে তিনি এই সমস্যার কোনো সমাধানে না গিয়ে মিয়ানমার ত্যাগ করে অস্ট্রেলিয়ায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগ দেন। এই ঘটনাতেই তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মেধার দিক থেকে নিজ ব্যাচের প্রায় শেষের দিকে অবস্থান করলেও সুফিউর সর্বদা মেধাবী ও জ্ঞানী হিসেবেই গর্ব করত। ব্যাচের প্রায় শেষের দিকে অবস্থান করলেও সুফিউর অস্ট্রেলিয়ায় হাইকমিশনার এবং পরে জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছেন—যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, দক্ষতার চেয়ে আনুগত্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ায় থাকা অবস্থায় তিনি আওয়ামীপন্থী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি তথাকথিত 'জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ' তৈরি করেন এবং ফলাও করে প্রচার করেন। এর উপর ভিত্তি করে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। দুঃখের বিষয়, এই 'ওয়ার্কিং গ্রুপ'-ই ছিল অস্ট্রেলিয়ায় হাইকমিশনার হিসেবে তার থাকার সময়ের একমাত্র সফলতা। অথচ, তিনি সেখানে থাকাকালীন অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের নিজস্ব জায়গায় কোনো ধরনের দূতাবাস নির্মাণের ব্যবস্থা না নিয়ে সেই জায়গা বিক্রি করতে চেয়েছিলেন।
হাইকমিশনে জুনিয়র নারী কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ সুবিধাভোগী তাহলিন মুন-কে তিনি বেআইনিভাবে ছয় বছরের অধিক সময় হাইকমিশনে পোস্টিংয়ে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। ৫ আগস্টের কয়েকদিন আগে সুফিউরের লবিংয়ের মাধ্যমে তাহলিন মুন শেখ হাসিনার কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান।
অস্ট্রেলিয়ায় আওয়ামী লীগের সক্রিয়তার ভিত্তিতে আওয়ামী ব্যবসায়ীদের সুপারিশে জেনেভাতে স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পান সুফিউর রহমান। যা বাংলাদেশের বিচারে শেখ হাসিনা সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জেনেভাতে থাকা অবস্থায় তিনি একাগ্রচিত্তে আওয়ামী সরকার ও শেখ হাসিনার মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ডিফেন্ড করেন। সে সময় জেনেভাতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলে, তার কারণে সেটি সফল হয়নি।
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ (UPR) চলাকালে, সুফিউর সুশীল সমাজ এবং বিবেকবান কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে পর্যালোচনা স্থগিত করার আহ্বান উপেক্ষা করেন। বরং তিনি বাংলাদেশের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিস্থিতি্র বিরুদ্ধে গিয়ে শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে রক্ষাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, রাজনৈতিক বন্দিত্ব এবং সুশীল সমাজের কর্মীদের বিচারিক হয়রানিকে তিনি যুক্তি দিয়ে ডিফেন্ড করতে চেষ্টা করেন। তিনি বিশেষভাবে দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ও বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় চালানো নিপীড়ক শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেন।
সুফিউর এক দশকের বেশি সময় বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে শেখ হাসিনার আনুগত্য করেছেন। তার অবসরোত্তর মেয়াদ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার বাড়িয়েছিল, যা তার প্রতি শেখ হাসিনার আস্থা ও পুরস্কারের প্রকাশ। শ্রীলংকা, মিয়ানমার, অস্ট্রেলিয়া ও জেনেভায় দায়িত্ব পালনকালে শেখ হাসিনার যথাযথ আনুগত্যের কারণে স্বাভাবিক অবসরের পর ০১ ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে তাকে জেনেভাস্থ জাতিসংঘের বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে স্থায়ী প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ দূতাবাস, জেনেভা, সুইজারল্যান্ডে রাষ্ট্রদূত পদে ৬ মাসের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়। শেখ হাসিনার পতনের মাত্র দুই মাস আগে ৩১ মে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।
সুফিউর রহমান জেনেভায় থাকাকালীন হাসিনা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ধামাচাপা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। এমনকি জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বারংবার সরকারের পক্ষে মিথ্যে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিরপেক্ষ না থেকে বিদেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রোগ্রামে সুফিউর নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছেন। অথচ এই সরকারের দাবি ছিল তারা শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে রক্ত দিয়ে বিজয় অর্জন করেছে। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে—কেন এই সরকার শেখ হাসিনার সবচেয়ে অনুগত একজন সাবেক কূটনীতিককে সবচেয়ে স্পর্ষকাতর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী পদে নিয়োগ দিয়েছে।
এটি কেবল নৈতিক প্রশ্ন নয়, এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের প্রশ্ন। আমাদের প্রজন্মের কাছে এসব ঘটনা তুলে ধরা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন, যাতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আমরা ভুলে যাই না—যার মাধ্যমে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তাকে পুরস্কৃত করলে ক্ষতির ধারাবাহিকতা থামে না, বরং নতুন রূপে ফিরে আসে। তিনি এমন একজন কূটনীতিক, যিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুরস্কার ভোগ করতে না করতেই ‘বিপ্লবী’ সরকারের পুরস্কারে ভূষিত হলেন। বিষয়টি রিতিমত উদ্বেগের।
সম্প্রতি পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিনকে অপসারণ করে রিয়াজ হামিদুল্লাহকে পররাষ্ট্র সচিব করার লক্ষ্যে যেসব অপপ্রচারমূলক ভিডিও প্রচার করা হয়েছে, তার পিছনে পররাষ্ট্র ক্যাডারের ১৫ ব্যাচসহ জুনিয়র কিছু অফিসারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে জানা গেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বিষয়টি আমলে না নিলে একই গ্রুপ নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য সুফিউর রহমানকে পররাষ্ট্র সচিবের চেয়েও উপরের পদে নিয়ে আসেন। এরই ধারাবাহিকতায় আজকে মোজাম্মেল পিটার সুফিউরকে প্রশংসা করে এবং তারা ফ্যাসিবাদের পক্ষের কূটনীতির সাফাই গাওয়ার অপচেষ্টা করেছে। আমার শুধু দুঃখ লেগেছে পররাষ্ট্র ক্যাডারের অফিসারদের নৈতিকতার এতই দুরবস্থা হয়েছে যে আজকে সুফিউরের মতো একজন সিনিয়র মোস্ট ডিপ্লোম্যাটকে মোজাম্মেলের মতো জুনিয়র ডিপ্লোম্যাটের endorsement ও vetting নিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়। আশা করি সুফিউর যেভাবে শেখ হাসিনার পক্ষে কাজ করেছেন, একইভাবে ইউনুসের পক্ষে কাজ করা অব্যাহত রাখবে!