পোপ ফ্রান্সিস
পোপ ফ্রান্সিস মারা গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের গুরুতর জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। এর আগে ইতালির রোমে একটি হাসপাতালে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা চলেছে তাঁর। ভ্যাটিকান জানিয়েছে, আজ সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে ভ্যাটিকানে নিজ বাসভবন কাসা সান্তা মার্তায় মারা যান তিনি।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত পোপ ফ্রান্সিসকে এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে বেশ কয়েকবার তাঁর শারীরিক অবস্থা বেশ গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়। ভ্যাটিকান জানায়, শ্বাসপ্রশ্বাস-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে পোপ ফ্রান্সিসকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। কদিন আগে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন পোপ।
ভ্যাটিকানের দাপ্তরিক ওয়েবসাইট ‘দি হোলি সি’–এর তথ্যমতে, পোপ ফ্রান্সিসের আগের নাম জর্জ মারিও বারগোগ্লিও। জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর, আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসের। বাবা মারিও আর রেগিনা সিভোরি। ইতালীয় অভিবাসী বাবা মারিও ছিলেন রেলওয়ের হিসাবরক্ষক।
কেমিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ধর্মের পথে পা বাড়ান জর্জ মারিও। পরবর্তী সময়ে তিনি দর্শন ও ধর্মতত্ত্বে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৯ সাল ধর্মযাজক হন। ১৯৯৮ সালে আর্জেন্টিনায় আর্চবিশপ হন তিনি।
বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০১৩ সালে তৎকালীন পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট পদ ছেড়ে দিলে পোপ নির্বাচিত হন জর্জ মারিও। নতুন নাম নেন ফ্রান্সিস। দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশ থেকে নির্বাচিত প্রথম পোপ তিনি।
১২ বছর ধরে রোমান ক্যাথলিক চার্চের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে পোপ ফ্রান্সিস বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ২১ বছর বয়সে তাঁর একটি ফুসফুসের কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়েছিল। ক্যাথলিক গির্জার বেশকিছু উদারনীতি ও সংস্কারের জন্য পোপ ফ্রান্সিস চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ক্যাথলিক খ্রিষ্টান, নন–ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস।
ধর্মযাজকের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের এবং কানাডার আদিবাসীদের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চেয়ে তিনি আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। সমলিঙ্গের যুগলদের আশীর্বাদ করতে রোমান ক্যাথলিক যাজকদের অনুমতি দিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস।
পোপ ফ্রান্সিস বলেছিলেন, ক্যাথলিক গির্জার দরজা সবার জন্য খোলা। এমনকি সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামীদের (এলজিবিটি) গির্জায় আসতে বাধা নেই। তাঁরা গির্জায় এসে প্রার্থনা করতে পারবেন। তবে, তাঁদের গির্জার নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে।
এ বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পেঙ্গুইন র্যানডম হাউস থেকে প্রকাশিত হয়েছে পোপ ফ্রান্সিসের আত্মজীবনী ‘হোপ’।
পোপ ফ্রান্সিস ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। এ সময় তিনি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করে সবার পক্ষ থেকে তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
প্রেমিকাকে না পেয়ে যেভাবে পোপ হয়েছিলেন ফ্রান্সিস
ছেলেবেলায় সমবয়সী এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। প্রেমিকাকে বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি বিয়ে না করো, তাহলে এ জীবন ঈশ্বরের সাধনায় উৎসর্গ করে দেব।’ কৈশোরে সেই প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ব্যথা বুকে নিয়েই পোপ এতটা পথ একলা পাড়ি দিয়েছেন। ধর্ম সাধনা করেছেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের পোপ হিসেবে।
পোপ ফ্রান্সিস ও তাঁর ছেলেবেলার প্রেমিকা এমিলিয়া দামন্তে (ইনসেটে)ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস ও সংগৃহীত
পোপ ফ্রান্সিসের আদি নাম হোর্হে মারিও বেরগোগলিও। ফ্রান্সিস নামটি বেছে নেন পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর। আর তাঁর স্বপ্নের সেই প্রেমিকার নাম এমিলিয়া দামন্তে। ২০১৩ সালে দুজনেরই বয়স যখন ৭৬ বছর, তখন সেই এমিলিয়াই প্রকাশ করেন তাঁদের গোপন প্রেমের খবর।
এমিলিয়া বলেন, ‘তখন আমরা ১২ বছরে পা দিয়েছি। থাকতাম আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসের ফ্লোরেস উপশহরে। বেরগোগলিও একদিন একটা চিঠি দিল। আমাকে বিয়ে করতে না পারলে সংসারত্যাগী হবে, ধর্মযাজক হয়ে যাবে বলেও জানিয়ে দিল।’
ফ্রান্সিসের ছোট বোন মারিয়া এলেনা বেরগোগলিও সে সময় দ্য টেলিগ্রাফকে বলেন, ‘আমার ভাই মৃদুভাষী। পৃথিবীর ১২০ কোটি রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টানের নেতা হওয়ার কোনো বাসনাই তাঁর ছিল না। কখনো পোপ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন না। আজ তিনি সারা বিশ্বের ক্যাথলিকদের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। এখন তাঁকে সীমাহীন নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হবে। আমি নিজেও চাইনি, আমার ভাই পোপ হন। কারণ, এতে তাঁর ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব বর্তাবে। তিনি আমাদের থেকে আরও দূরে চলে যাবেন।’
তবে পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর ভাইকে নিয়ে গর্বিতই ছিলেন মারিয়া। তিনি বলেন, ‘এ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ইউরোপের বাইরে আমার ভাই–ই প্রথম পোপ নির্বাচিত হয়েছেন। লাতিন আমেরিকা ও আমাদের জন্মভূমি আর্জেন্টিনা থেকে তিনিই প্রথম নির্বাচিত পোপ। ঈশ্বরের সদয় কৃপা ছাড়া এমন ভাই পাওয়া যায় না।’
২০১৩ সালে বেরগোগলি পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর এমিলিয়া বলেন, ‘আজ আর আমার লুকানোর কিছু নেই। ওটা ছিল অবুঝ প্রেম। আমাদের সম্পর্ক ছিল পবিত্র। তবে আমার মা–বাবার বাধার কারণে সেই প্রেম বিকশিত হয়নি। চিঠিটিতে একটি ঘরের ছবি এঁকেছিল সে। ছাদ লাল রঙের। ওর স্বপ্ন ছিল, এমন একটি ঘর কিনবে, বিয়ের পর আমাকে নিয়ে সেখানে থাকবে। চিঠি পড়ল বাবার হাতে। তিনি তো রেগে আগুন। আমাকে আচ্ছামতো পেটালেন বাবা। এর পর থেকে ওকে আর কখনো দেখিনি। মা–বাবা আমাকে দূরে দূরে সরিয়ে রাখতেন। ওর সঙ্গে দেখা হোক, তা চাইতেন না। একপর্যায়ে আমিও চাইতাম, ও যেন আমার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যায়। তা–ই হয়েছিল, ধীরে ধীরে দূরে সরে গিয়েছিল সে।’
একজন পোপ মারা যাওয়ার পর কী ঘটে?
ঐতিহ্যগতভাবে পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া একটি বিস্তৃত ও জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিস পুরো প্রক্রিয়াটি অপেক্ষাকৃত কম জটিল করার একটি পরিকল্পনায় কয়েক দিন আগে অনুমোদন দিয়েছিলেন।
আগের পোপদের সাইপ্রেস, সিসা ও ওক কাঠে তৈরি তিন স্তরের কফিনে ভরে সমাহিত করা হয়েছে। পোপ ফ্রান্সিস দস্তা দিয়ে মোড়ানো সাধারণ কাঠের তৈরি একটি কফিনে তাঁকে সমাহিত করার বিষয়ে অনুমোদন দিয়ে গেছেন।
সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় একটি উঁচু স্থানে পোপের মৃতদেহ রাখার ঐতিহ্যবাহী নিয়মও বাতিল করে গেছেন পোপ ফ্রান্সিস। এর পরিবর্তে শোকগ্রস্ত মানুষকে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর মৃতদেহ ঢাকনা খোলা অবস্থায় কফিনের ভেতর রাখতে বলেছেন।
পোপ ফ্রান্সিসকে ভ্যাটিকানের বাইরে সমাহিত করা হবে। এক শতাব্দীর বেশি সময়ের মধ্যে তিনিই প্রথম পোপ, যাঁর সমাধি ভ্যাটিকানের বাইরে হতে চলেছে। পোপ ফ্রান্সিসকে সেন্ট মেরি মেজরের ব্যাসিলিকায় সমাহিত করা হবে। রোমের প্রধান চারটি প্যাপল ব্যাসিলিকার একটি হচ্ছে এটি। ব্যাসিলিকা হলো এমন গির্জা যেগুলোকে ভ্যাটিকান থেকে বিশেষ গুরুত্ব এবং বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পোপের সঙ্গে মেজর ব্যাসিলিকার সুনির্দিষ্ট যোগাযোগ আছে।
কারা নতুন পোপ নির্বাচন করবেন?
রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা নতুন পোপ নির্বাচন করেন। যাঁরা পোপ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেন, তাদের কলেজ অব কার্ডিনালস বলা হয়। তাঁরা সবাই পুরুষ এবং পোপের মাধ্যমে তাঁরা সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত, সাধারণত বিশপ হিসেবে নিযুক্ত থাকেন। বর্তমানে ২৫২ জন ক্যাথলিক কার্ডিনাল আছেন। তাঁদের মধ্যে ১৩৮ জন নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য ভোট দিতে পারবেন।
বাকিদের মধ্যে যাঁদের বয়স ৮০ বছরের বেশি, তাঁরা পোপ নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না। তবে নতুন পোপ হিসেবে কাকে বেছে নেওয়া উচিত, সেই বিতর্কে তাঁরা অংশ নিতে পারবেন।
ঐতিহ্যগতভাবে সিস্টিন চ্যাপেলের চিমনি দিয়ে সাদা ধোঁয়া ওড়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের বারান্দায় দেখা দেন নতুন পোপ।
কে পোপ হতে পারবেন?
তাত্ত্বিকভাবে, যেকোনো রোমান ক্যাথলিক পুরুষ যাঁর ব্যাপ্তিস্মা (খ্রিষ্টান ধর্মের একটি আচার) করা আছে, তিনি পোপ নির্বাচনের যোগ্য বলে বিবেচিত হন। তবে বাস্তবে কার্ডিনালরা নিজেদের ভেতর থেকে একজনকে পোপ হিসেবে বেছে নিতে চান।
আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বেছে নেওয়া প্রথম কোনো পোপ। ২০১৩ সালে তিনি পোপ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, কার্ডিনালরা বেশিরভাগ সময় ইউরোপ বিশেষ করে ইতালি থেকে কাউকে পোপ হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
এখন পর্যন্ত ২৬৬ জন পোপ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২১৭ জনই ইতালির নাগরিক।
সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ ও দ্য গার্ডিয়ান
সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ ও দ্য গার্ডিয়ান