ড. মোহাম্মদ ইউনুস, মাঝখানে ড. ফজলে হাসান আবেদ, ডানপাশে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
ছবিতে দেখা যাচ্ছে তিনজন মহান মানুষকে। একজন আমাদের সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস, মাঝখানে ড. ফজলে হাসান আবেদ, আর তাঁর ডানপাশে দাঁড়িয়ে আছেন ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মেধা, উচ্চতা ও আদর্শে তাঁরা সময়কে অতিক্রম করে গেছেন।
এই তিন জন—তাঁদের প্রজ্ঞা, উচ্চতা, আর সময়কে ছাপিয়ে যাওয়া ব্যক্তিত্বের ছায়ায় দেশ, জাতি, মানবতা আলোকিত হয়েছে! আজ তাঁদের মধ্যে দুজন নেই। তাঁদের কথা, তাঁদের কাজ, তাঁদের রেখে যাওয়া আলো প্রতিদিন আমাদের ছুঁয়ে যায়।
১১ এপ্রিল ছিল ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটিতে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করেছি। সেদিন সংবাদপত্রে কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো আয়োজনেই তাঁকে নিয়ে তেমন কিছু দেখিনি। বিস্ময়ের সঙ্গেই ভেবেছি —একজন নির্ভীক দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল চিন্তার অগ্রদূতের মৃত্যুতেই কি সব শেষ হয়ে যায়?
১৯৮১ সালের কথা। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল ওসমানী অংশ নিয়েছিলেন নাগরিক কমিটির ব্যানারে। ড. জাফরুল্লাহ ছিলেন সেই কমিটির আহ্বায়ক। তখন আমি একজন ছাত্রসংগঠক, প্রাণে উদ্যম, বিশ্ব জয় করার মন্ত্র বুকে।
তিন দিনে সিলেট অঞ্চলে ৭০টি নির্বাচনি সভার তালিকা আমার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। মাঠে নেমে দ্রুতই বুঝতে পারি—মানুষ জেনারেল ওসমানীকে শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন, কিন্তু রাজনৈতিক কাঠামো ছাড়া ভালোবাসা দিয়ে নির্বাচন জয় করা কঠিন। তাঁর নেতৃত্বে থাকা জনতা দলে ছিল কিছু ভালো নেতা ছিলেন, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল সীমিত।ছিলাম আমরা কিছু বাম ঘরানার ঢাল তরোয়ালহীন তরুণ।
সে সময় সিলেট শহর থেকে বিয়ানীবাজার, বড়লেখা হয়ে মৌলভীবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ পথে একদিনে অর্ধশাতাধিক পথসভা করেছেন জেনারেল ওসমানী ও ড. জাফরুল্লাহ। জিপগাড়িতে চালকের পাশে জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মাঝের আসনে জেনারেল সাহেব, পাশে তাঁর ডায়েরি, নথিপত্র, এবং সোল্ডারে রাখা চকচকে নলের পিস্তল।
গাড়ির পেছনে আমি এবং আমার অনুসারী আফছর বা শ্যামল। পালা করে মাইকে - " ওসমানী স্যারের সালাম জানাই, মই মার্কায় ভোট চাই" বলে স্লোগান দিচ্ছিলাম।
জাফরুল্লাহ ভাই বললেন, : ওসমানী স্যার নয় , ওসমানী ভাই বলো।
: বলো " ওসমানী ভাইয়ের সালাম নিন- মই মার্কায় ভোট দিন।
পিস্তলের নলের দিকে চোখ রেখে আমার উত্তর, জাফর ভাই - এ স্লোগান মুখ দিয়ে আসছে না। জেনারেল সাহেব কাঁধ ঝাঁকুনি দিলেন !
ড. জাফরুল্লাহ মাঝে মাঝে পেছনে ফিরে কথা বলছেন—চোখ লাল, চেহারায় কঠোরতা। মাঝেমধ্যেই ইংরেজিতে জেনারেল ও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আলাপ। —আমাদের কাছে তখন প্রায় দুর্বোধ্য, মাঝে মাঝে ধমক আর নানা নাটকীয় কাহিনি ঘটছিলো।
সেই নির্বাচনি সময়ের ভূমিকার কারণেই তাঁদের দৃষ্টিতে কাকতালীয়ভাবে পড়ে যাই।
১৯৮২ সালে সামরিক শাসন জারির পর জীবনের প্রথম চাকরির জন্য হাজির হয়েছিলাম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে, হাতে ছিল জেনারেল ওসমানীর লেখা একটি সুপারিশপত্র—যার ভিতরে কী লেখা ছিল, আমি জানতাম না। পত্র হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন জাফারুল্লাহ চৌধুরী। বললেন, এটিতো তদবিরপত্র নয়, আমার প্রতি নির্দেশনামা!
সেদিনই কাজে লাগিয়ে দিলেন।
ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে কেউ কখনও “স্যার” বলে ডাকার সুযোগ ছিলো না। দেশে ঔষধনীতির নৈরাজ্য ভাঙার এক অগ্রপথিক হয়ে উঠলেন এরশাদের সামরিক শাসনের সময়ে। ছিলেন নিঃস্বার্থ, নির্ভীক এক দেশপ্রেমিক। দেশ মাতৃকার জন্য পশ্চিমের দেশ ছেড়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। এক জামা পরে কাটিয়েছেন মাসের পর মাস।
তাঁকে মাপার যোগ্যতা তখনও আমার ছিল না, আজও নেই। নিজেকে উজাড় করে দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর কাছে 'ব্যক্তিগত' বলে কিছু ছিলো না। নানা সময়ে নিগ্রহের শিকার হয়েছে। দূর দেশ থেকে দেখেছি, পুকুরের মাছ চুরির মামলায়ও তাঁকে জড়ানো হয়েছিলো !
রাজনীতি বড়ই নিষ্ঠুর ! - এমনটাই দেখেছি, দেখছি।
সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে দেশ, জাতি, বিশ্ব এমন কিছু মানুষ পায়- যার একজন ছিলেন কর্মবীর দেশপ্রেমিক জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গভীর শ্রদ্ধা, অপার ভালোবাসা আর একরাশ ভাবালুতায় তাঁকে স্মরণ করছি হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে।
লেখক: ইব্রাহিম চৌধুরী, সম্পাদক, প্রথম আলো, উত্তর আমেরিকা