জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রথম ইফতার মাহফিলে আমন্ত্রণ পাওয়া ছিল এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। গত মঙ্গলবার সেখানে উপস্থিত থাকতে পারাটা আমি বেশ উপভোগ করেছি। মনে পড়ে গেছে ছাত্রজীবনে ঠিক এমনই এক আয়োজনে প্রথমবারের মতো যোগ দেওয়ার স্মৃতি—ষাটের দশকের শেষ দিকে, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (ইপিএসইউ) দশম জাতীয় সম্মেলন। এই দুটি আয়োজনের মধ্যে মিল হলো—উভয় ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন মূলত তরুণ ও শিক্ষার্থী।
তাদের প্রাণশক্তি, স্বপ্নে ভরা চোখ, যেকোনো কাজে বিপুল আগ্রহ আমাকে যেন ফিরিয়ে নিয়ে যায় ছয় দশক পিছনে সেই আমার ছাত্র জীবনে। আমরাও সেইসময় প্রগতিশীল চিন্তাধারা, তথা মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আঁকড়ে ধরে, তারুণ্যের শক্তিতে বলিয়ান একটি সমতাপূর্ণ সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখতাম।
বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রয়োজন, যেটি তারুণ্যের শক্তিতে ভরপুর, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত এবং গরিব ও নিপীড়িত মানুষকে সত্যিকারেই ভালবাসবে। এমন একটি দল প্রয়োজন, যারা অত্যাচার ও শোষণের শৃঙ্খল মুক্ত ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখবে। এমন একটি দল দরকার, যারা আমাদের সামনে এগিয়ে নেবে, পিছনে নয়। দীর্ঘদিন ধরে আমরা এমন রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের শাসনে আছি, যাদের একমাত্র লক্ষ্য ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থরক্ষা। আমাদের দরকার একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দল—যারা সবার অধিকার ও জনগণের সমৃদ্ধির জন্য কাজ করবে।
সেদিক থেকে এনসিপির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তাদের কিছু মৌলিক বিষয় এখনও অস্পষ্ট—আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি, বৈচিত্র্যের প্রতি গ্রহণযোগ্যতা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে অবস্থান, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ইত্যাদি। তাদের উচিত, যত দ্রুত সম্ভব পার্টি চার্টার প্রকাশ করা।
পরিবর্তনের এক অনির্দিষ্ট, অদৃশ্য সুবাস বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। সেখানে পরিবেশে ছিল এক দৃঢ় সংকল্পের উপস্থিতি, যা আমরা সবাই প্রত্যাশা করি। শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অতিথিদের মাঝে বসে উপলব্ধি করলাম, এনসিপি ইতোমধ্যেই সবার মাঝে ব্যাপক আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে না হলেও, ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের।
আয়োজনে তাদের শীর্ষ তিন নেতার বক্তৃতা শুনে আলাদা করে যে বিষয়টি আমার দৃষ্টিগোচর হলো, এত নেতার মধ্যে মাত্র তিনজনই কথা বললেন, তাও খুব সংক্ষিপ্ত। আমার মনে প্রশ্ন জাগছিল, পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর যে হতাশাজনক ব্যর্থতা, সেখানে এই শিক্ষার্থীরা ও তাদের নেতারা কি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে অবহিত? তারা কি জানে যে চারপাশে হাজারো বিষাক্ত সাপ ফণা তুলে আছে, অবৈধ টাকার বাক্স হাতে দাঁড়িয়ে আছে, যাতে সেই টাকায় তাদের ভাসিয়ে দেওয়া যায়? তারা কি বুঝতে পারবে যে কোনটি প্রকৃত অর্থে সহযোগিতা, আর কোনটি ফাঁদ? তারা কি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে জর্জরিত করে রাখা চাটুকারিতার সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে পারবে?
বাংলাদেশের ১৯৭২-১৯৯১ সালের ইতিহাসের শুরু অসংখ্য শুভ সূচনার সঙ্গে একটি আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষার সংমিশ্রণে এবং এর শেষ পরিণতি হয়, একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড। এরপর দুটি সামরিক অভ্যুত্থান, যার মাধ্যমে দুই জেনারেল ক্ষমতায় আসেন—জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এইচ. এম. এরশাদ। দুজনেই ক্ষমতায় বসে রাজনৈতিক দল গঠন করেন—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জাতীয় পার্টি (জাপা)। দল দুটি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছে।
আমাদের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি নিয়ন্ত্রিত হয় পরিবারতন্ত্রের ধারায়। দলের ভেতরে কোনো ধরনের গণতন্ত্র নেই। দলীয় পদ-পদবী কারা পাবে, তা একজন ব্যক্তি ইচ্ছাধীন, কোনো নির্বাচন নেই। মজার বিষয় হলো, জামায়াতই একমাত্র দল, যারা তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব নির্বাচনের কাঠামো অনুসরণ করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৫৪ বছরের ইতিহাস দেখলে, বিশেষ করে গণতন্ত্র ও নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর গত ৩৪ বছরের ইতিহাস দেখে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও দুঃখজনক বিষয় হলো, দলগুলো সবসময় দলের চেয়ে নেতাকে এবং দেশের চেয়ে দলকে এগিয়ে রেখেছে। জনস্বার্থ নয়, দলীয় স্বার্থ রক্ষাই তাদের মূল লক্ষ্য। কোনো বড় রাজনৈতিক দলেই ভেতরেই গণতন্ত্র নেই। তাদের দল পরিচালনার পদ্ধতি এতটাই কেন্দ্রীভূত যে, একজন ব্যক্তিই সব সিদ্ধান্ত নেন, তার ইচ্ছাই দলের জন্য চূড়ান্ত আদেশ।
স্বজনপ্রীতি ও চাটুকারিতা তাদের নিত্যদিনের চর্চা। এর ফলে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে, যারা নিজেদের আনুগত্য দেখিয়ে দলীয় কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে শৃঙ্খলা নষ্ট করেছে। তারা সাংগঠনিক নির্বাচন সময়মতো আয়োজন করেনি—সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে তো নয়ই। দলের সর্বনিম্ন স্তর থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত কে কোন পদে থাকবে, তা মনোনীত হতো উপর থেকে—কেবলমাত্র শীর্ষ পদ ও কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে ঘটা ব্যতিক্রম ছাড়া।
বছরের পর বছর দলীয় পদ 'বিক্রি' হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের সময় 'মনোনয়ন বাণিজ্য' থাকতো সবার মুখে মুখে। দলীয় টিকিট পেতে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হতো। ফলে, তারা নির্বাচিত হতে পারলে 'বিনিয়োগের' কয়েকগুণ উসুল করে নিতো উন্নয়ন তহবিল থেকে। দলীয় তহবিল সংগ্রহ ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে চাঁদাবাজির এটা আরেকটা রূপ। শুধু শীর্ষ নেতৃত্বই নয়, বরং মনোনয়ন নিশ্চিতে সহযোগিতা করতে পারে, এমন প্রত্যেকেই এই চাঁদাবাজির সুবিধা নিতো।
দুর্নীতি রাজনৈতিক দলগুলোর এতটাই গভীরভাবে প্রোথিত ছিল যে, এটি আমলাতন্ত্রেও ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রশাসনের ভেতরে থাকা দুর্নীতিবাজরা এই সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে দ্রুত ও চূড়ান্তভাবে নিজেদের এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করে ফেলে। পুলিশ পরিণত হয় দমন, নির্যাতন ও চাঁদাবাজির হাতিয়ার। রাজনৈতিক দলগুলো বড় আকারে দুর্নীতিতে জড়িত থাকায় আমলাতন্ত্র, পুলিশ, বিচারব্যবস্থা এবং নিঃসন্দেহে, করপোরেট জগতকে কখনোই জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়নি। গণমাধ্যমের একটি অংশ মালিকপক্ষের চাপে ও কিছু সুবিধাভোগী সাংবাদিকদের ইচ্ছায় এই প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে যায়।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সংকীর্ণ, স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন ও স্বার্থপর ইতিহাসের এই প্রেক্ষাপটে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরাই, যারা আমাদেরকে মুক্ত করেছে দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচারের কবল থেকে। তারা দল নিয়ে কতটা সফল হতে পারবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
উপরোল্লিখিত ইফতারে একজন অত্যুৎসাহী ঘোষক তাদের নেতাকে 'জননেতা' ও 'এক দফার ঘোষক' বলে অভিহিত করেছেন। এই প্রবণতা এড়িয়ে চলা উচিত। ইতিহাসই নির্ধারণ করবে কে কী। আত্মপ্রচারের ফাঁদে পা দেওয়া উচিত না। ক্ষমতায় যাওয়া নয়, বরং জনগণের সেবা করার সুযোগ পাওয়াই এনসিপির প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। দলের ভেতরে যে সংস্কৃতি তাদের অনুসরণ করা উচিত এবং যে কাজটি তাদের অন্য সবার থেকে আলাদা করবে, তা হলো জবাবদিহিতা। এই জবাবদিহিতা শুধু জনগণের কাছে নয়, বরং দলের ভেতরেও, এমনকি তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছ পর্যন্ত থাকতে হবে। তাদের উচিত আর্থিক বিষয়গুলোতে স্বচ্ছতা বজায় রাখার চর্চাকে বাধ্যতামূলক করে নেওয়া। এটা না থাকার কারণেই আমাদের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলো ধ্বংস হয়েছে।
আজ আওয়ামী লীগ চিহ্নিত হচ্ছে দুর্নীতিগ্রস্ত দল হিসেবে। কারণ, তারা সম্পূর্ণ দায়মুক্ত অবস্থায় দেশের শাসন ক্ষমতায় থেকে অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছ। তাদের তুলনায় বিএনপি ভালো অবস্থানে রয়েছে। কেননা, তারা নিপীড়নের শিকার এবং নির্বাচনে কারচুপি করে তাদের ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার পটপরিবর্তনের বিষয়টি অন্য রকম হলে কি হতো, সেটা এখন কেবল ধারণাই করা সম্ভব।
জামায়াত বেশিরভাগ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় 'টাকা'র বিষয়ে তাদের বিচার করার জন্য আমাদের কাছে তেমন তথ্য নেই। তবে, বিএনপির সঙ্গে জোট সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালীন তাদের অনৈতিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। বর্তমানে তাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো, নিজেদের লোককে আনুগত্যের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর চেষ্টা। এটা দুর্নীতিরই আরেক রূপ।
এনসিপি দুটি ব্যয়বহুল, তবে প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। একটি মানিক মিয়া এভিনিউতে দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান এবং অপরটি ইন্টারকন্টিনেন্টালে ইফতার। আমাদের ধারণা, এই দুই অনুষ্ঠানের ব্যয় বহন করেছে পৃষ্ঠপোষকরা। তবে আমরা মনে করি, বিষয়টি তখনই গ্রহণযোগ্যতা পাবে, যখন এই পৃষ্ঠপোষকদের নাম-পরিচয় জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। যেকোনো নতুন দলের জন্যই পৃষ্ঠপোষক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, তাদের উচিত দু-একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল না হওয়া এবং পৃষ্ঠপোষকদের নাম-পরিচয় গোপন না রাখা। অবশ্যই পৃষ্ঠপোষকদের নাম সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত। এটা করতে পারলে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে উঠবে এনসিপি, বাড়বে তাদের গ্রহণযোগ্যতা। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং দল গঠনের এই পর্যায়ে সর্বসাধারণের গ্রহণযোগ্যতা তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রয়োজন, যা সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে উঠে এসেছে। কিন্তু একইসঙ্গে, আমাদের একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও প্রয়োজন, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামোগত পরিবর্তন আসবে। দলে গণতন্ত্র থাকতে হবে এবং তাদের জবাবদিহির আওতায় আসতে হবে।
আবারও বলছি, আমাদের অনেক ব্যর্থতার মূল কারণ হলো নেতা ও তার পরিবারের স্বার্থকে দলের চেয়ে বড় করে দেখা এবং দলের স্বার্থকে দেশের থেকে এগিয়ে রাখা। এনসিপি এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র—এই তিনটি বিষয় চর্চা করতে পারলে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে উঠবে এনসিপি। তারা নিয়ে আসতে পারবে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। তাদের এই নতুন যাত্রার জন্য আমাদের শুভ কামনা।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
Editor in Chief
Dulal Ahmed Chowdhury
News
Email: news@newsdiplomats.com
Advertisement
Email: ads@newsdiplomats.com
© The_News_Diplomats || Published from Canada.