স্ত্রী ফরিদা খাতুনের সঙ্গে অধ্যাপক টি এ চৌধুরী
টি এ চৌধুরী নামের আড়ালে ঢাকা পড়েছে অধ্যাপক এ এইচ এম তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরী নামটি। দেশের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিষয়ের কিংবদন্তিতুল্য এই চিকিৎসক দীর্ঘ ছয় দশক নারীদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন। আজ ৯ মার্চ দুপুরে ঢাকায় নিজ বাসভবনে তিনি মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। টি এ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রথম আলোর বিশেষ ম্যাগাজিন ‘বর্ণিল ভালো থাকুন ২০২৪’–এ প্রকাশিত লেখাটি পাঠকদের জন্য তুলে দেওয়া হলো।
অধ্যাপক টি এ চৌধুরীর জন্ম ঢাকায়, ১৯৩৭ সালের ১১ অক্টোবর। তাঁর বাবা মজিরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। স্কুলে যাওয়ার বয়সে তাঁর বাবা বদলি হয়ে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়, সে কারণে টি এ চৌধুরীর স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় পেরিয়ে গিয়েছিল। তাঁর চাচা একদিন সরাসরি ভর্তি করে দিলেন তৃতীয় শ্রেণিতে। তাতে যা হওয়ার তা-ই হলো, স্কুলে মোটেও ভালো করছিলেন না। বেশির ভাগ বিষয়ে টেনেটুনে পাস করেন।
এভাবেই চলছিল। দেশভাগের পর বাবা সপরিবার ঢাকায় ফিরে এলেন। এবার প্রথমে ভর্তি হলেন আজিমপুরের ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে, তারপর সপ্তম শ্রেণিতে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। স্কুলে কখনোই প্রথম সারির ছাত্র ছিলেন না, খুব ভালো ফল কখনোই করতে পারেননি। কিন্তু এই ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকেই ১৯৫৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় স্টার নম্বর পেয়ে পাস করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। ভর্তি হলেন ঢাকা কলেজে।
১৯৫৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেন। টি এ চৌধুরীর মনের সুপ্ত ইচ্ছা ছিল গণিত বা পদার্থবিদ্যা পড়বেন। কিন্তু একটি ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিকেল ফিটনেস পরীক্ষায় হার্টে একটি জন্মগত ত্রুটির জন্য তাঁকে আনফিট ঘোষণা করে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এই বোর্ডে কোনো বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। জেদ চেপে গেল টি এ চৌধুরীর। তিনি আপিল করলেন কলেজের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। তাঁর আপিলের কারণে একজন হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া হলো। যিনি রায় দিলেন টি এ চৌধুরীর পক্ষে। ভর্তি হলেন তিনি। ১৯৬০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকেই এমবিবিএস পাস করলেন অসামান্য রেজাল্ট করে। পেলেন স্বর্ণপদক।
স্ত্রীরোগ নিয়ে পড়াশোনা
সে সময় এমবিবিএস পাস করার পর চিকিৎসকদের বিনা বেতনে অনারারি ট্রেনিং করতে হতো। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ট্রেনিং করার সময় টি এ চৌধুরী শুনতে পেলেন, বিলেতে না গিয়েই এফআরসিএস ডিগ্রির প্রথম পর্ব তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই দেওয়া সম্ভব। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এফআরসিএসের প্রথম পর্ব পরীক্ষায় অংশ নেবেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে ১০ জন চিকিৎসক সুযোগ পেলেন, তিনি ছিলেন এর একজন। ছয় মাসের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে লাহোরে চলে গেলেন। সফলতার সঙ্গে পাসও করলেন।
এবার দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত করতে বিলেতে যাওয়ার পালা। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বাঙালিদের বেলায় পদে পদে বাধা সৃষ্টি করতে থাকল। এ–সংক্রান্ত কাগজপত্র ইসলামাবাদ থেকে আসে। তারা আপত্তি তোলে এই বলে যে কোনো প্লেসমেন্ট ছাড়া এই চিকিৎসকদের বিলেতে পাঠানো যাবে না। সে সময় শফিউল আজম নামের একজন বাঙালি সচিব ছিলেন, যিনি বারবার এই দাবি তুলে আসছিলেন যে যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রায় নেই, তাই এখান থেকে চিকিৎসকদের বিলেতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। তাদের কোনো প্লেসমেন্ট লাগবে না, তারা নিজ উদ্যোগে নিজেদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে নেবে। মূলত তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় বিলেতে বাঙালি চিকিৎসকদের যাওয়া সহজ হয়ে ওঠে।
লন্ডন থেকে এফআরসিএসের দ্বিতীয় পর্ব পাস করার পর টি এ চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার তিনি স্ত্রীরোগ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি এমআরসিওজি করবেন। কেন এই বিষয়?
প্রথম কারণ, এমবিবিএসে তিনি এই বিষয়েই ভালো নম্বর পেয়েছিলেন। সেখানে স্ত্রীরোগ বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন ডা. নুরুল ইসলাম। তিনি তাঁকে উৎসাহ দিয়েছিলেন এই বিষয় পড়তে। তা ছাড়া এফআরসিএসে তাঁর বিষয় ছিল পেলভিক সার্জারি, যা গাইনি পড়তে তাঁকে আরও উৎসাহী করেছিল। কিন্তু এখানেও পশ্চিম পাকিস্তান বাদ সাধল। চিঠি এল অবিলম্বে দেশে ফিরে যেতে, নইলে পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হবে।
অনেক চিঠিপত্র চালাচালির পর আরও কিছুদিন ইংল্যান্ডে থাকার অনুমতি মিলল। ১৯৬৫ সালে এমআরসিওজি পাস করে দেশে ফিরলেন টি এ চৌধুরী।
সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছেন শিক্ষকতায়
দেশে ফিরে টি এ চৌধুরীর প্রথম পদায়ন হলো স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে। এখানে তখন এলএমএফ চিকিৎসকেরা শর্ট কোর্সে এমবিবিএস করতে আসত। সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পরপর আটটি ব্যাচ পড়িয়েছেন টি এ চৌধুরী। তিনি বলছিলেন, ‘যদিও তারা এলএমএফ চিকিৎসক ছিল, কিন্তু তাদের মতো মনোযোগী ও প্রাজ্ঞ ছাত্র খুব কমই পেয়েছি। খুবই আনন্দ পেয়েছি তাদের পড়িয়ে।’
১৯৭১ সালের দিকে বদলি হলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে, সেখানেই অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেলেন। স্বাধীনতার পরপর ঢাকার শাহবাগ হোটেলকে চিকিৎসাশিক্ষার উচ্চতর প্রতিষ্ঠান আইপিজিএমআরে (ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল রিসার্চ) পরিণত করা হলো। জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কারিগর। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এত অল্পসংখ্যক চিকিৎসককে উন্নত প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে বিপুল মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে না। তার চেয়ে দেশেই উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আইপিজিএমআরে যোগ দেওয়ার জন্য টি এ চৌধুরীকে ডেকে পাঠালেন তিনি। কিন্তু এখানেও শুরু হলো নানা চক্রান্ত। শেষ পর্যন্ত সব বাধা সরিয়ে টি এ চৌধুরী আইপিজিএমআরে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগে যোগ দিলেন।
পরবর্তী ২০ বছর এখানেই নবীন ও তরুণ সব গাইনি চিকিৎসককে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন। শিক্ষকতায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন তিনি। ক্লাসে কখনোই রোলকল করতেন না। কারণ, তিনি জানতেন যে তাঁর ক্লাসে কেউ অনুপস্থিত থাকে না। এমনকি তাঁর যেদিন পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের ক্লাস থাকত, সেদিন ঢাকার বাইরে থেকে শিক্ষার্থীরা ভোরে ক্লাস করতে চলে আসত। গতানুগতিকতার বাইরে পড়াতে পছন্দ করতেন। এ দেশে স্ত্রীরোগ বিষয়ে নতুন নতুন ও আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতির প্রচলন তিনিই শুরু করেছিলেন। যেমন ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি, মাইক্রোসার্জারি, গাইনি অনকোলজি, ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার পথিকৃৎ তিনি। এখন প্রসূতি বিষয় বহুধাবিভক্ত হয়েছে, নানা বিশেষায়িত বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও উচ্চতর ডিগ্রি চালু হয়েছে। এ দেশের নারীরা নানা আধুনিক চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। ভুলে গেলে চলবে না, এর শুরুটা তাঁদের মতো মানুষদের হাতেই।
ফরিদা ক্লিনিক
লন্ডন থেকে ফেরার এক বছর পর ১৯৬৬ সালে টি এ চৌধুরীর বিয়ে হয় ফরিদা খাতুনের সঙ্গে। ফরিদা খাতুন ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা তাঁর জুনিয়র চিকিৎসক। চাকরি করতেন প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগে। তারপর মিটফোর্ড হাসপাতালে কাজ করার সময় ভাবলেন, নিজে স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। চাকরি ছেড়ে শান্তিনগরে গড়ে তুললেন দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি ক্লিনিক। নিজের নামেই ক্লিনিকের নাম—ফরিদা ক্লিনিক।
ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত নারীরা স্বল্প ব্যয়ে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে গাইনিবিষয়ক সেবার জন্য আসতে শুরু করলেন এই ক্লিনিকে। স্বামী-স্ত্রী দুজন বসতেন ক্লিনিকে—রোগী দেখতেন, অপারেশন বা ডেলিভারি করতেন। ক্লিনিকের নাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ষাটের দশকের শেষে ঢাকায় স্ত্রীরোগবিষয়ক এ রকম ক্লিনিক বা বেসরকারি হাসপাতাল হাতে গোনা ছিল। সেই ১৯৬৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই ক্লিনিকেই কাজ করছেন দুজন।
অধ্যাপক টি এ চৌধুরীর সহধর্মিণী ডা. ফরিদা খাতুন এখনো প্রায় রোজই গিয়ে বসেন ক্লিনিকে। মাঝেমধ্যে যোগ দেন তাঁর স্বামীও। দুজনেরই বয়স হয়েছে, শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগবালাই। হুইলচেয়ার ও সহকারী ছাড়া চলতে পারেন না। তবু কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেননি।
সপ্তাহে অন্তত এক দিন বারডেমে যান
আইপিজিএমআর থেকে অবসর নেওয়ার পর অধ্যাপক টি এ চৌধুরী বারডেম হাসপাতালে যোগ দেন প্রয়াত অধ্যাপক ডা. ইব্রাহিমের আহ্বানে। এখনো এই হাসপাতালের অবৈতনিক অধ্যাপক হিসেবে রয়েছেন তিনি। সপ্তাহে অন্তত এক দিন বারডেমে যান। রোগী দেখেন, জুনিয়র চিকিৎসকদের পরামর্শ দেন। সভা, সেমিনারে অংশ নেন। এখনো নিয়মিত পড়াশোনা করেন, নতুন কিছু এলেই তা জানতে চেষ্টা করেন। হেসে জানালেন, ‘বুড়ো বয়সে সবকিছু কম্পিউটারনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেল। আমিও নিজেকে পাল্টালাম। নিজে নিজেই কম্পিউটারের সব কারিকুরি শিখেছি। এখন পড়াশোনা, ডাউনলোড, আর্টিকেল লেখার কাজগুলো নিজেই করি কম্পিউটারে।’
নোয়াখালীর সেনবাগে প্রত্যন্ত এলাকায় নিজেদের গ্রামের বাড়িতে একটা স্কুল করেছেন। গ্রামের তিন শতাধিক শিশু এখানে পড়ে। যাদের বেশির ভাগই মেয়ে। বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের সভাপতি ছিলেন একসময়। প্রায় ২০ বছর এখানে নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিলেন। সেটাও খুব প্রিয় জায়গা। তবে সবচেয়ে প্রিয় জায়গা শান্তিনগরের ছায়াঘেরা বাড়িটা।
গাছগাছালি খুব ভালোবাসেন ফরিদা খাতুন। একসময় বাড়ির ছাদে ২০ প্রজাতির গোলাপ ফুটিয়েছিলেন। এখন স্বাস্থ্যের জন্য আর পারেন না। পশুপাখির প্রতিও তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা। বাড়িতে আছে বিড়াল ও কুকুর।
টি এ চৌধুরী ও ফরিদা খাতুন দম্পতির তিন মেয়ে। বড় মেয়ে নাসরিন সাবিনা চৌধুরী ফ্রিল্যান্স ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। মেজ মেয়ে তানজিম সাবিনা চৌধুরী চিকিৎসক। বাবার মতো গাইনির নামকরা অধ্যাপক। কাজ করেন বারডেম হাসপাতালে। আর ছোট মেয়ে নুসরাত সাবিনা চৌধুরী থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে, সেখানে অ্যানথ্রোপলজি বিষয়ে এমএস ও পিএইচডি সম্পন্ন করার পর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
টি এ চৌধুরী মানুষের ভালোবাসার পাশাপাশি দেশে–বিদেশে কাজের স্বীকৃতি ও সম্মাননাও পেয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে পান স্বাধীনতা পুরস্কার।
Editor in Chief
Dulal Ahmed Chowdhury
News
Email: news@newsdiplomats.com
Advertisement
Email: ads@newsdiplomats.com
© The_News_Diplomats || Published from Canada.