ষড়যন্ত্র হটিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জয়যুক্ত হয়েছেন!

২০ জুন পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব নিতে পারেন আসাদ আলম সিয়াম # জসিম উদ্দিন কানাডায় হাইকমিশনার # নাহিদা সোবহান জেনেভায় স্থায়ী প্রতিনিধি # তারেক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূত # মঞ্জুরুল করিম খান যাচ্ছেন মালয়েশিয়ায় # সামিনা নাজ এখনও বঞ্চিত

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন আপাতত জয়যুক্ত হয়েছেন। অনেকটা ‘কালো মেঘে ঢেকে পড়া’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আপাতত তিনি ‘উদ্বার’ করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা। এসব কর্মকর্তারা বলেছেন, ভেতরে-বাহিরের একটি প্রভাবশালী স্বার্থন্বেষী মহলের পরিকল্পিত হিংস্ত্র থাবায় সেগুনবাগিচাকে মেরুদণ্ডহীন ও নখ-দন্তহীনে পরিণত করার সক্রিয় প্রচেষ্ঠা ছিলো। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ জেনেভায় চুক্তিতে থাকা একজন কূটনীতিককে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী নিয়োগ এবং কতিপয় সিনিয়র কূটনীতিক সিন্ডিকেট করে রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের পোস্টিং নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্ঠা করেছিলো। এই চক্রের গভীর ষড়যন্ত্রে মাত্র ৮ মাসের মাথায় বিদায় নিতে হয়েছে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিনকে। কর্মকর্তাদের মতে, দেশি-বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গতি থেমে গিয়েছিলো। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা শিরদাঁড়া সোজা করার ফলে খাদের কিনার থেকে আপাতত টেনে তোলা সম্ভব হয়েছে। জুনের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবারও পূর্ণ গতিশীল হবে বলে এসব কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেন।
জানা গেছে, অনেকটা নিশ্চিত হওয়ার পরও পররাষ্ট্র সচিব হওয়ার দৌড় থেকে ছিটকে পড়েন দিল্লীতে নিযুক্ত হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহ। উপদেষ্টার কঠোর অবস্থানের কারণে অবশেষে প্রধান উপদেষ্টা রিয়াজ হামিদুল্লাহর পরিবর্তে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আসাদ আলম সিয়ামকে পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে নিয়োগে সম্মত হন। চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের গোড়ার দিকে তিনি ঢাকা পৌঁছে দায়িত্ব গ্রহণের কথা রয়েছে। গত মঙ্গলবার সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) বৈঠকে অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়ামকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র সচিব হতে তার সামনে আর কোনো বাধা নেই। চলতি বছরের শুরুর দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৭ জন অতিরিক্ত সচিব মর্যাদার কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে সচিব মর্যাদা পেলেও সিয়াম বঞ্চিত ছিলেন। তিনি পররাষ্ট্র ক্যাডারের ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা।
এদিকে সদ্য প্রাক্তন পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনকে কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পররাষ্ট্রসচিব পদে রদবদলে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের পর জল্পনা ছিল, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হবেন জসীম উদ্দিন। কিন্তু মঙ্গলবার সরকার তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে নয়, কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুত্রমতে, ইতোমধ্যে তার এগ্রিমো কানাডা সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে।
আলোচনা রয়েছে, সরকারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত, শীর্ষ কতিপয়ের ইচ্ছামাফিক নির্দেশনা না শুনা, নতুন বিশেষ সহকারীকে সেগুনবাগিচায় আসতে না দেয়া, কতিপয় ইউটিউবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক না রাখাসহ বিভিন্ন কারণে মাত্র ৮ মাসের মাথায় পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিনকে ছুটিতে যেতে হয়েছে। বিশেষ করে রাখাইনে মানবিক করিডোর নিয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের পর থেকে তার বিদায়ের গুঞ্জন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
একই সঙ্গে কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার নাহিদা সোবহানকে মাত্র ৯ মাসের মাথায় জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হচ্ছে। আর জেনেভায় জাতিসংঘ সদরদপ্তরে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবে কর্মরত তারেক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলামকে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগের সিদ্ধান্তে নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে তেহরানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মঞ্জুরুল করিম খানকে পাঠানো হচ্ছে মালয়েশিয়ায়। আর কাতারে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মো. নজরুল ইসলাম মস্কোয় রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন অতি সম্প্রতি। এমাসেই তার নতুন কর্মস্থলে যোগদানের কথা রয়েছে।
সুত্র জানায়, এসব নিয়োগের সামারি প্রধান উপদেষ্টাকে দিয়ে সাক্ষর করিয়ে এবং রাষ্ট্রদূতদের এগ্রিমো সংশ্লিষ্ট দেশসমুহে পাঠানো নিশ্চিত করেই গতকালই যুক্তরাষ্ট্রে ওড়াল দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। সুত্রমতে, দুসপ্তাহের ছুটি নিয়ে তিন যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন মেয়ের সঙ্গে ঈদ পালন ও অবকাশ যাপন করতে। তিনি আপাতত আশ্বস্ত হয়েছেন, নতুন কোনো জঞ্জাল আর তার জন্য সৃষ্টি হবে না।
নাহিদা ফিরে যাচ্ছেন তার পূর্বের কর্মস্থলে
রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান জেনেভা থেকে জর্ডান হয়ে কানাডায় পোস্টিং পান আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কিছুদিন আগে। অভিযোগ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরপরই তিনি জর্ডান থেকে ঢাকা পৌঁছান। সেখান থেকে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের পরামর্শে দ্রুত রওয়ানা দেন অটোয়ার উদ্দেশ্যে। সরকার পতনের ৬ দিনের মধ্যেই তিনি যোগ দেন কানাডার রাষ্ট্রদূত হিসাবে। কিন্তু মাত্র ৯ মাসের মাথায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্তে তিনি কানাডা থেকে পুর্বের কর্মস্থল জেনেভায় ফিরে যাচ্ছেন। যেখানে তিনি ইতোপূর্বে ৯ বছর সেখানে কর্মরত ছিলেন। অবশ্য এখন যাচ্ছেন দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবে। নাহিদা সোবহান তড়িগড়ি করে অটোয়ায় যোগদানের পর তার ও তার স্বামী কাতারে রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলামের (মস্কোয় রাষ্ট্রদূত হিসাবে পদায়িত) বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে। যোগদানের পর থেকে কানাডায়ও তিনি বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সমালোচিত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত তারেক মো. আরিফুল ইসলাম
বিসিএস (পররাষ্ট্র ক্যাডার) ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা তারেক মো. আরিফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে কূটনীতি ও বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। জেনেভায় জাতিসংঘের দপ্তরগুলোয় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করছেন গত বছরের জুন থেকে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, আওয়ামী লীগের সময়ে চুক্তিতে থাকা রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি। পররাষ্ট্র সচিব হতে আসাদ আলম সিয়ামকে ঢাকায় তলবের পর তারেক মো. আরিফুল ইসলামকে ওয়াশিংটনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
পেশাগত জীবনে তারেক মো. আরিফুল ইসলাম নিউইয়র্কে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনে বাংলাদেশের উপস্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি কলকাতায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশন এবং ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মহাপরিচালকের (দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগ) দায়িত্ব পালন করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, তারেক মো. আরিফুল ইসলামের কূটনৈতিক পেশাদারিত্ব, কর্মদক্ষতা, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা কারো সঙ্গে তুলনা হয় না। দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এরকম কূটনীতিক মন্ত্রণালয়ে খুবই কম রয়েছেন। সরকার ওয়াশিংটনের জন্য যোগ্যতম কূটনীতিককেই বিবেচনায় নিয়েছে।

সামিনা নাজ এখনও বঞ্চিত

এদিকে ১৫ তম ব্যাচের কূটনীতিক সামিনা নাজ দীর্ঘদিন ভিয়েতনামের পর বর্তমানে মিশরে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। এসব দেশে ক্যান্সারের সুচিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় অনেকটা চিকিৎসাহীন অবস্থায় অকালে স্বামী হারিয়েছেন। দুই শিশু হয়েছে পিতৃহারা। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি নিজেও। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা তাকে শুধু সান্তনাই দিয়ে যাচ্ছেন। উন্নত চিকিৎসা হয়, এমন কোনো দেশে পোস্টিং-এর জন্য বলতে বলতে এখন তিনি ক্লান্ত।  বিগত সরকারের সময়ে ছিলেন বঞ্চিত, এখনও অসংখ্য রদবদল হলেও তার ভাগ্যের শিকে ছিঁড়েনি। নিউজিল্যান্ড মিশন খোলা হলে তাকে দায়িত্ব দেয়া হবে, এই ‘মুলা’ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তার সামনে ৬ মাসেরও বেশি সময় থেকে। অথচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমেরিকা উইং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েছেন দীর্ঘদিন। রাষ্ট্রদূত হিসাবেও তার কর্মদক্ষতা ও সততা প্রশ্নাতীত।