নবদম্পতি রাজা রঘুবংশী ও সোনম
বিয়ের মাত্র দশদিনের মাথায় মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর থেকে মেঘালয়ে মধুচন্দ্রিমায় এসে ভাড়াটে খুনী সহযোগে স্বামীকেই হত্যা করান এক নববধু। শেষমেশ বধুটি উত্তর প্রদেশ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। উত্তর প্রদেশের গাজীপুরে গিয়ে মেঘালয় পুলিশ সোনম রঘুবংশী (২৪) নামের বধুটিকে ট্রানজিট রিমান্ডে শিলং নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি ইন্দোর এবং গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে আরও চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বুধবার সবাইকে শিলং আদালতে সোর্পদ করে রিমান্ডে নেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে পুলিশ। খুন হওয়া নববিবাহিত যুবকের নাম রাজা রঘুবংশী (২৯)।
আর খুনের পর্দা ফাঁস হওয়ায় রাজনৈতিক চাপান উতোরের অবসান ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, খুনের ঘটনা নিয়ে একদিকে দুই রাজ্য সরকার তৎপর হয়ে উঠে। দোষারোপের পালা শুরু হয়। অন্যদিকে, বিষয়টি নিয়ে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলেন। যদিও তাঁর এক কেবিনেট সদস্য এবং সুপরিচিত বিজেপি নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি লিখেন। জাতীয় স্তরের বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যম একপক্ষীয়ভাবে পুরো উত্তর পূর্বাঞ্চলকে ‘অপরাধ প্রবণ অঞ্চল’ বলে অভিহিত করতে থাকে। যে কারণে আজ শিলং থেকে ৫৪ কিমি দূরবর্তী সোহরায় প্রতিবাদ মিছিল বেরিয়েছে। এতে স্থানীয় বিধায়ক সহ অন্য জন প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। আবার হিন্দি বলয়ের সামাজিক মাধ্যম ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়িয়ে ফেলে।
তবে এই খুনকে কেন্দ্র করে এত বেশী দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে বলিউডি হিন্দি ছবিকেও হার মানাবে। ঘটনার সূত্রপাত গত ১১মে। সেদিন ইন্দোরের ট্রান্সপোর্টার রাজা রঘুবংশীর সঙ্গে সোনমের বিয়ে হয়। ২০ মে নবদম্পতি হানিমুনের জন্য শিলং পৌঁছান। তাদের গন্তব্য ছিল শিলংয়ের জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট সোহরা। ২২ মে দু’জন সাগর সেন শ্যামল নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে চারদিনের জন্য একটি স্কুটি ভাড়া করেন। সেদিন বিকেলেই তারা নংরিয়াতে মেঘালয়ের সুপরিচিত ডাবল-ডেকার সেতুতে যান। পরদিন অর্থাৎ ২৩ মে গ্রাম প্রধান পুলিশকে জানান যে একটি রেস্টুরেন্টের পাশে পরিত্যক্ত একটি স্কুটি রয়েছে। স্কুটিতে চাবি ঝোলানো রয়েছে। ২৪ মে থেকে রাজা-সোনমের পরিবার ইন্দোর থেকে বিভিন্নভাবে দু’জনের খোঁজ করতে থাকে। ২৭ মে যখন মধ্যপ্রদেশ সরকার বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে তখনই স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের টনক নড়ে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় খুঁজতে গিয়ে পুলিশ দু’টি ব্যাগ উদ্ধার করে। কিন্তু কোনোভাবেই নবদম্পতির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। ২৮ মে ইন্দোরের সাংসদ শঙ্কর লালওয়ানি শিলং পৌঁছে বরিষ্ঠ পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে দেখা করেন এবং ওই দম্পত্তিকে খুঁজে বের করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন।
এমন আবহে পুরো উত্তর পূর্ব জুড়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে খাদ ও ঘন জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে তল্লাশি চালানো বেশ প্রতিকূল হয়ে ওঠে। ৩০ মে ফের তল্লাশি শুরু করেও ৩১ মে একই কারণে তা স্থগিত করে দেয় পুলিশ। আবহাওয়া খানিকটা অনুকূল হওয়ার পর পুলিশ, আধাসেনা, দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী একযোগে তল্লাশি শুরু করে। পরে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বিশেষ ড্রোন এনে ২ জুন একটি খাদ থেকে রাজার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহের পাশ থেকে একটি দা উদ্ধার হওয়ার পর পুলিশ এটাকে হত্যা বলে মধ্যপ্রদেশ সরকারকে জানিয়ে দেয়। কিন্তু সোনমের কোনো খোঁজ না পাওয়ায় তার পরিবার প্রকাশ্যে অভিযোগ করে যে দুষ্কৃতিরা রাজকে হত্যা করে তাকে বাংলাদেশে নিয়ে গেছে। পরিবারের এমন অভিযোগকে সামনে রেখে হিন্দি বলয়ের সামাজিক মাধ্যম হামলে পড়ে। এবার মোহন যাদব কেন্দ্রকে চিঠি লিখে তদন্তের ভার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-র হাতে তুলে দিতে অনুরোধ করেন। যদিও মেঘালয় সরকার আগেই একটি বিশেষ তদন্তকারী দল (এসআইটি) গঠন করে জোরদার তদন্ত শুরু করে। তাই চাপে পড়ে গত রবিবার রাত ৩ টা নাগাদ বারাণসী-গাজীপুর হাইওয়ের একটি ধাবায় গিয়ে হাজির হন সোনম। বিধ্বস্ত অবস্থায় ধাবা মালিকের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে তার ভাইকে ভিডিও কল করেন। ভাই তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি ইন্দোর পুলিশকে জানান।
আবার ধাবা মালিকও উত্তর প্রদেশ পুলিশের হেল্পলাইনে বিষয়টি জানিয়ে দেন। অবশ্য এর আগেই উত্তর ও মধ্যপ্রদেশ পুলিশ আকাশ রাজপুত (১৯), বিশাল সিং চৌহান (২২) এবং রাজ সিং কুশওয়াকে (২১) আটক করে। কারণ,শিলংয়ে এক স্থানীয় গাইড পুলিশকে জানিয়েছিলেন যে, ওই নবদম্পতির সঙ্গে আরও দুই-তিনজনেকে দেখেছিলেন তিনি। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে যে নংরিয়াতে একটি হোম-স্টেয় তিনজন লোক অবস্থান করেছিলেন। পাশাপাশি সোনমের মোবাইলের কল রেকর্ড খতিয়ে দেখে তারা জানতে পারে যে তার সঙ্গে রাজ সিং কুশওয়ার অগুনতি কথোপকথন রয়েছে। তাই মেঘালয় পুলিশ এদের সন্ধান করতে ওই দুই রাজ্য পুলিশকে অনুরোধ করে। ইস্ট খাসি হিলস জেলার এসপি বিবেক সিয়েম সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, এভাবেই খুনের রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে মধ্যপ্রদেশের সাগর জেলা থেকে আনন্দ কূর্মি (২৩) নামেও আরেকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এসপির দেওয়া তথ্য মতে,২৩ মে খুন হন রাজা। তার মাথায় ও গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। রাজ কুশওয়ার সঙ্গে সোনমের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তাই স্বামীকে খুন করার জন্য সোনমই প্রেমিককে দায়িত্ব দেয়। অবশ্য রাজ নিজে শিলং আসেনি। বাকি তিনজনকে পাঠিয়ে দেয়। ওরা রাজাকে খুন করে গুয়াহাটি থেকে ট্রেন ধরে ফিরে যায়। এদের ট্রানজিট রিমান্ডে শিলং নিয়ে আসা হচ্ছে। এর পরেই পুরো ঘটনা খোলসা হবে বলে জানান এসপি সিয়েম।