করমুক্ত ও নগদ প্রণোদনার সুযোগ নিয়ে এক ব্যবসায়ী রেমিট্যান্সের (প্রবাসী আয়) নামে ৭৩০ কোটি টাকা দেশে এনেছেন বলে সোমবার এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও বিসিএস কর ক্যাডারদের এক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানালেও তিনি ওই ব্যক্তির নাম ও পরিচয় উল্লেখ করেননি। কালবেলার অনুসন্ধানে তার নাম-পরিচয় জানা গেছে। তার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ ফারুকী হাসান। তিনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া কানাডার অন্টারিও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। যদিও এনবিআর চেয়ারম্যান ৭৩০ কোটি টাকার কথা বলেছেন, তবে তার আয়কর ফাইল ঘেঁটে দেখা গেছে, এই টাকার পরিমাণ ৭২১ কোটি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোনো ধরনের দালিলিক প্রমাণ ছাড়া তিনটি চীনা কোম্পানির নাম ব্যবহার করে এসব প্রবাসী আয় হিসেবে আয়কর ফাইলে প্রদর্শন করেন। ফারুকী হাসান বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় নানা প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ কর সুবিধা নিয়েছেন। আর এই কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন কর অঞ্চল-৫-এর তৎকালীন কর কমিশনার, রেঞ্জ কর্মকর্তা ও উপকমিশনার। ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তারা ফারুকী হাসানের চার করবর্ষের ২৩১ কোটি টাকার এসব অনিয়মের ফাইলটি পুনঃউন্মোচন করেও মাত্র সাড়ে ১৫ হাজার টাকার কর দাবি সৃষ্টি করে নিষ্পত্তি করেন। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে এনবিআর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান এস এম ফারুকী হাসান তিনটি চীনা প্রতিষ্ঠান নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন লিমিটেড, চায়না শিপবিল্ডিং ও অফসোর ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির থেকে ৯টি করবর্ষে ৭২১ কোটি টাকা নিয়ে আসেন। তিন চীনা কোম্পানি থেকে নিয়ে আসা টাকাকে প্রবাসী আয় হিসেবে দাবি করেন। তিনি ২০১৭-১৮ করবর্ষে প্রবাসী আয় হিসেবে আয়কর ফাইলে প্রদর্শন করেন ৬ কোটি ২৯ লাখ ৮১ হাজার ১০৪ টাকা; ২০১৮-১৯ করবর্ষে ৯ কোটি ৯২ লাখ ২৩ হাজার ৫৬২; ২০১৯-২০ করবর্ষে ৩৫ কোটি ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৩২৩ এবং ২০২০-২১ করবর্ষে প্রদর্শন করেন ২৩১ কোটি ৯৯ লাখ ১৫ হাজার ৩১৪ টাকা। অর্থাৎ চার করবর্ষে প্রবাসী হিসেবে আয়কর ফাইলে প্রদর্শন করেন ২৭২ কোটি ৪৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। অথচ চার করবর্ষের এই বিশাল অঙ্কের টাকার বিপরীতে কর আইনের ৯৩ ধারায় করদাতার ফাইল পুনঃউন্মোচন করে দুই করবর্ষের মধ্যে ২০১৭-১৮ করবর্ষে মাত্র ৪৪৮ টাকা এবং ২০১৮-১৯ করবর্ষের মাত্র ১৫ হাজার ৯৫ টাকা কর দাবি সৃষ্টি করেন। আর ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ করবর্ষে কোনো দাবি না করেই নিষ্পত্তি করেন। আর এই কাজটি করেছেন কর অঞ্চল-৫-এর তৎকালীন কমিশনার, রেঞ্জ-১-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার ও তৎকালীন এক উপকমিশনার।
গতকাল মঙ্গলবার বিষয়টি নিয়ে কথা হলে এক উপকমিশনার কালবেলাকে বলেন, ‘প্রতীক গ্রুপ ফরেন রেমিট্যান্স হিসেবে আয়কর ফাইলে অর্থ প্রদর্শন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে আসার কারণে আয়কর কর্মকর্তাদের আসলে কিছু করার নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কর কর্মকর্তাদের কর আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর প্রমাণাদি তো অবশ্যই আছে।’
সূত্র আরও জানায়, প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয়ে প্রদর্শন করেন ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ করবর্ষে। আলোচ্য সময়ে তিনি প্রবাসী আয় হিসেবে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করেন ৫০০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০২২-২৩ করবর্ষে প্রবাসী আয় হিসেবে আয়কর ফাইলে প্রদর্শন করেন ৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬১ টাকা আর ২০২৩-২৪ করবর্ষে প্রবাসী আয় দেখান ৮১ কোটি ১ লাখ ৩৭ হাজার ১৪৪ টাকা। এর আগে ২০১৭-১৮ করবর্ষে ৬ কোটি ২৯ লাখ ৮১ হাজার ১০৪ টাকা; ২০১৮-১৯ করবর্ষে ৯ কোটি ৯২ লাখ ২৩ হাজার ৫৬২; ২০১৯-২০ করবর্ষে ৩৫ কোটি ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৩২৩ এবং ২০২০-২১ করবর্ষে ২৩১ কোটি ৯৯ লাখ ১৫ হাজার ৩১৪ টাকা প্রবাসী আয় দেখান। এরও আগে ২০১২-১৩ করবর্ষে প্রবাসী আয় দেখান ১ কোটি ২৪ লাখ ৫৯ হাজার ২৪৪ টাকা ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ৯৬৩ টাকা।
প্রতীক গ্রুপের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনী বছর এবং সরকারের কালো টাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগের বছরে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ অস্বাভাবিক প্রবাসী আয়ের নামে টাকা নিয়ে এসেছেন কানাডা আওয়ামী লীগের প্রভাশালী নেতা এস এম ফারুকী হাসান।
এনবিআরের আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৯১-এর ষষ্ঠ তপশিলের পার্ট-এ অনুচ্ছেদ ৪৮ অনুযায়ী, দেশে অবস্থান করে প্রবাসী আয় হিসেবে করমুক্ত আয় দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। একই আইনের ৯৩ ধারা অনুযায়ী, পরবর্তী করবর্ষে কর মামলা হিসেবে আয়কর ফাইল পুনঃউন্মোচন করার সুযোগ রয়েছে।
কে এই ফারুকী হাসান: ফারুকী হাসান মূলত আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন। তিনি কানাডার অন্টারিও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মালিকানাধীন প্রতীকে গ্রুপের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে রাজধানী গুলশান-২ অবস্থিত হোটেল লেক ক্যাসেল, প্রতীক সিরামিক লিমিটেড, প্রতীক ডেভেলপার্স লিমিটেড, প্রতীক ফুড অ্যান্ড এলাইড, প্রতীক লজিস্টিকসহ বেশকিছু কোম্পানি। ফারুক হাসান ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইরও সদস্য। বিগত সরকার তাকে সিআইপি মর্যাদায়ও ভূষিত করেছে।
খবর: দৈনিক কালবেলা
NEWSDIPLOMATS.COM
The Latest Breaking News
Dulal Ahmed Chowdhury
Editor in Chief
Email: dulalca73@gmail.com