ইসরায়েলের হামলায় ইরানে বিধ্বস্ত একটি ভবন
ইসরায়েল আজ শুক্রবার ভোররাতে ইরানে বিমান হামলা চালিয়েছে। তেহরানের ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ওমানে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আয়োজিত একটি বৈঠকের একদিন আগেই এ হামলার ঘটনা ঘটল। ২০২৩ সালে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কয়েকবার ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। তেহরানে ইসরায়েলের সবশেষ এই হামলার ফলে দুই দেশের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে।
ইসরায়েল ও ইরানের শত্রুতা নতুন কিছু নয়। কয়েক দশক ধরে দুই দেশ স্থল, সমুদ্র, আকাশ এবং সাইবার হামলাসহ একে অপরের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে আসছে। এসব সংঘাত তাদের সম্পর্ককে বৈরিতার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যা এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ্য যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে গত কয়েক দশকে হওয়া প্রধান প্রধান উত্তেজনাপূর্ণ কিছু ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো—
১৯৭৯: ইরানে বিপ্লব
ইরানের পশ্চিমাপন্থী নেতা মোহাম্মদ রেজা শাহ ইসরায়েলকে মিত্র দেশ হিসেবে বিবেচনা করতেন। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের ফলে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। এই বিপ্লবের ফলে ইরানে শিয়াপন্থী ধর্মতন্ত্রভিত্তিক একটি নতুন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শাসনব্যবস্থার আদর্শগত নীতির অন্যতম ভিত্তি ছিল ইসরায়েলবিরোধিতা।
১৯৮২: হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠা
এ বছর ইসরায়েল লেবাননে আক্রমণ চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটির শিয়া মুসলিম নেতারা সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ গড়ে তোলে। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)। পরবর্তী সময়ে এই আধাসামরিক সংগঠনটি সীমান্তে ইসরায়েলের সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসের বিদেশি শাখা কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডকে স্বাগত জানায় ইসরায়েল। ইরাকের বাগদাদে একটি মার্কিন ড্রোন হামলায় তিনি নিহত হয়েছিলেন। এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরাকে বিভিন্ন মার্কিন সেনা ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ইরান। এসব হামলায় প্রায় ১০০ মার্কিন সামরিক সদস্য আহত হন।
১৯৮৩: লেবাননে ইসরায়েলি সেনাঘাঁটিতে হামলা
লেবানন থেকে পশ্চিমা ও ইসরায়েলি বাহিনীকে বিতাড়িত করতে ইরান–সমর্থিত হিজবুল্লাহ আত্মঘাতী বোমা হামলার কৌশল গ্রহণ করে। এ বছরের নভেম্বর মাসে বিস্ফোরক ভর্তি একটি গাড়ি লেবাননে ইসরায়েলের সামরিক সদর দপ্তরে ঢুকে হামলা চালায়। এরপর ইসরায়েল লেবাননের বেশির ভাগ এলাকা থেকে সরে আসে।
১৯৯২-৯৪: আর্জেন্টিনায় হামলা
আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে ১৯৯২ সালে ইসরায়েলি দূতাবাস এবং একটি জুইশ সেন্টারে আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে। এতে বহু মানুষ নিহত হন। আর্জেন্টিনা ও ইসরায়েল এ হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে ইরান ও হিজবুল্লাহকে দায়ী করে। তবে ইরান ও হিজবুল্লাহ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
২০০২: ইরানোর পরমাণু কর্মসূচি
ইরানের গোপন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি ফাঁস হওয়ার ফলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয় যে, তারা পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারে। আর এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে তা হবে দেশটির আন্তর্জাতিক চুক্তির পরিপন্থী। যদিও ইরান এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। অন্যদিকে এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল তেহরানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়।
২০০৬: ইসরায়েল–হিজবুল্লাহ যুদ্ধ
ওই বছর লেবাননে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ মাসব্যাপী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ইসরায়েল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হিজবুল্লাহকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে কার্যকরী একটি সমঝোতার মধ্য দিয়ে ওই যুদ্ধের অবসান ঘটে।
২০০৯: ‘ইসরায়েল হচ্ছে ক্যানসার’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এক বক্তৃতায় ইসরায়েলকে ‘একটি বিপজ্জনক ও প্রাণঘাতী ক্যানসার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
২০১০: পরমাণু স্থাপনায় সাইবার হামলা
ওই বছর তেহরানের নাতাঞ্জ এলাকায় একটি পারমাণবিক কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় সাইবার হামলা চালানো হয়। এ হামলায় স্টাক্সনেট নামের একটি কম্পিউটার ভাইরাস ব্যবহার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এই ভাইরাস তৈরি করেছে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। ওই হামলাকে শিল্প যন্ত্রপাতির ওপর প্রথম কোনো প্রকাশ্য সাইবার হামলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০১২: ইরানি বিজ্ঞানী নিহত
নিজ গাড়িতে বোমা বিস্ফোরিত হয়ে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী মোস্তফা আহমাদি-রোশন নিহত হন। তেহরানে একটি মোটরসাইকেল আরোহী তাঁর গাড়িতে বোমাটি স্থাপন করে। এক স্থানীয় কর্মকর্তার অভিযোগ, ওই হামলার পেছনে ইসরায়েলের হাত ছিল।
২০১৮: সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলা
ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশংসা করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেন তিনি। এর আগে বছরের পর বছর ধরে ট্রাম্প প্রশাসন ওই চুক্তির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছিল।
মে মাসে ইসরায়েল জানায়, তারা সিরিয়ায় ইরানের একটি সামরিক অবকাঠামোতে হামলা চালিয়েছে। এর আগে দেশটির ইসরায়েল–নিয়ন্ত্রিত গোলান মালভূমিতে রকেট ছুড়েছিল ইরানি সামরিক বাহিনী। ওই সময় গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল তেহরান।
২০২০: কাসেম সুলাইমানিকে হত্যা
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসের বিদেশি শাখা কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডকে স্বাগত জানায় ইসরায়েল। ইরাকের বাগদাদে একটি মার্কিন ড্রোন হামলায় তিনি নিহত হয়েছিলেন। এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরাকে বিভিন্ন মার্কিন সেনাঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এসব হামলায় প্রায় ১০০ মার্কিন সামরিক সদস্য আহত হন।
২০২১: ইরানের পরমাণু কর্মসূচির পরিকল্পনাকারীকে হত্যা
মোহসেন ফখরিজাদেহের হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে ইরান। মোহসেনকে ইরানের গোপন পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচির মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচনা করত পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তবে ইরান লম্বা সময় ধরে এ ধরনের কোনো পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করে আসছে।
২০২২: যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েল চুক্তি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদ এক যৌথ প্রতিশ্রুতিনামায় স্বাক্ষর করেন। এতে তাঁরা একসঙ্গে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র গ্রহণে বাধা দিতে সম্মত হন। দীর্ঘদিন ধরে তেহরান ইস্যুতে কূটনৈতিকভাবে বিভক্ত মিত্রদেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রতীক হিসেবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
এই প্রতিশ্রুতি মূলত ‘জেরুজালেম ঘোষণার’ একটি অংশ। এটি প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের ইসরায়েলে প্রথম সফরের সেরা অর্জন। এর ঠিক একদিন আগে বাইডেন স্থানীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেলে বলেন, প্রয়োজনে ইরানের বিরুদ্ধে শেষমেশ ‘শক্তি প্রয়োগ’ করতেও প্রস্তুত তিনি।
এপ্রিল ২০২৪: ইরানি দূতাবাসে হামলা
সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের দূতাবাস প্রাঙ্গণে সন্দেহভাজন ইসরায়েলি বিমান হামলায় রেভল্যুশনারি গার্ডের সাত কর্মকর্তা নিহত হন। এর মধ্যে দুজন সিনিয়র কমান্ডারও ছিলেন। যদিও ইসরায়েল এ হামলার দায় স্বীকার বা অস্বীকার করেনি।
অক্টোবর ২০২৪
গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর লেবাননের বৈরুতের দক্ষিণ উপশহরে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ এবং এর আগে ৩১ জুলাই ইরানের রাজধানীতে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করা হয়। এর প্রতিশোধ নিতে গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলে ১৮০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান।
জবাবে ওই মাসের শেষ দিকে ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। তবে এসব হামলা খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করে ইরান।
গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর লেবাননের বৈরুতের দক্ষিণ উপশহরে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ এবং ৩১ জুলাই ইরানের রাজধানীতে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করা হয়। এর প্রতিশোধ নিতে গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলে ১৮০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান।
জুন ২০২৫
ইসরায়েল ইরানে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইসরায়েল বলেছে, তেহরানের পারমাণবিক অবকাঠামো এবং পারমাণবিক বোমার জন্য কাজ করা বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়েছে। এ অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’। এ হামলায় ইরানের কমান্ডার ও ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলোও নিশানা করা হয়। ইরানের পাল্টা হামলার আশঙ্কায় ইসরায়েলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, এ হামলায় ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান হোসেইন সালামি ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী ফারেদুন আব্বাসি এবং মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি নিহত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র জানায়, তারা এই অভিযানে কোনো সহায়তা করেনি। এ হামলার একদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন কর্মীদের সরানো হচ্ছে। কারণ, ‘অঞ্চলটি বিপজ্জনক হতে পারে।’